একজন শিল্পী বা আর্টিস্ট আর জিনিয়াসের মধ্যে তফাৎ প্রায় কিছুই নেই। শিল্পীদের কাজ দেখলে আমরা খুশি হই, ভাল লাগে তাদের কাজ। কিছু ক্ষেত্রে তাদের শিল্পের মাধ্যমে আমাদের ভাবতেও শেখায়। জিনিয়াসরাও কিন্তু নিজের কাজের মাধ্যমে বেশ কিছু শিক্ষার রসদ দিয়ে যান প্রায়শই। ভাবতে বাধ্যও করেন আমাদের। যুগোস্লাভিয়ার মারিনা আব্রামোভিচ নামক এই মহিলাকে ‘গ্র্যান্ডমাদার অফ পারফরম্যান্স আর্ট’ নামে ডাকা হয়। তাঁর চল্লিশ বছরের টাইম স্প্যানে এমন কিছু কাজ করেছেন মারিনা, যা দেখে চমকে গেছে গোটা বিশ্ব। এরকমই এক চমকপ্রদ পারফরম্যান্সের কথাই বলা যাক আজ। মারিনার একদম প্রথম দিকের একটা পিস, নাম ‘রিদম জিরো’। সম্ভবত তাঁর সব থেকে সেরা পারফরম্যান্স এটি।
১৯৭৪ সালের নেপলসে স্টুডিও মোরায় বেশ কয়েকজন পুরুষ ও মহিলাকে ডেকে মারিনা একটি প্রদর্শনীর আয়োজন করেন। প্রদর্শনীর অংশ হিসেবে একটি বড় ঘরের মাঝখানে একটা চেয়ার ও টেবিল রাখা ছিল। টেবিলের ওপর ছিল বেশ কিছু অবজেক্ট, একটা সাইনবোর্ড আর একটা কাগজ। সেই টেবিলে তিন রকম জিনিস রাখা ছিল। প্রথমটি ‘নর্ম্যাল’ যার মধ্যে ছিল ফুলের তোড়া, মোমবাতি, কাগজ কলম থেকে লিপস্টিক, চকলেট, মারিনার কিছু প্রাইভেট ফটো ইত্যাদি সাধারণ জিনিস। দ্বিতীয়টি ছিল ‘অবজেক্ট অফ প্লেজার’, যার মধ্যে পালক, মধু, পারফিউম, আঙুরের থোকা, মদের বোতল আর হুইপ জাতীয় সেক্স টয় উল্লেখযোগ্য। তিন নম্বরটি, ‘অবজেক্ট অফ ডিস্ট্রাকশন’, যার মধ্যে রাখা ছিল ছুরি, কাঁচি, পেরেক, শেকল, দড়ি, লোহার রড আর একটা লোডেড বন্দুক, যাতে একটাই গুলি। সাইনবোর্ডটায় লেখা, “টেবিলে বাহাত্তরটা আলাদা আলাদা জিনিস রাখা আছে। আগামী ছ’ঘন্টা এগুলোর থেকে যেটা ইচ্ছা আমার ওপর যেভাবে খুশি প্রয়োগ করতে পারেন, আমি কোনোরকম বাধা দেব না।” পাশের কাগজটায় মারিনার সই সমেত অনুমতিপত্রও ছিল। সময় ছিল রাত আটটা থেকে দুটো অব্দি, ছ’ঘন্টা। এই সময়টায় মারিনা পুরো স্ট্যাচু হয়ে থাকবেন। ওঁর সাথে যে যা খুশি করতে পারে, দায় সম্পূর্ণ তাঁরই।
এই অভিনব প্রদর্শনী দেখতে দূর-দূরান্ত থেকে বহু রিপোর্টার ও আর্ট ক্রিটিক গিয়েছিলেন। প্রথম ১৫ মিনিট কাটার পর মারিনাকে খেলার পুতুল ভেবে দর্শকরা কেউ এসে মারিনার হাতটা উঠিয়ে দিলেন, কেউ মাথাটা ঘুরিয়ে দিলেন একদিকে। কেউ তাঁকে চেয়ারে বসিয়ে দিলেন, আবার কেউ এসে চেয়ার থেকে তুলে দাঁড় করিয়ে দিলেন। বিখ্যাত আর্ট ক্রিটিক থমাস ম্যাকভেলি ঘরের একপাশে বসেছিলেন। তিনি খেয়াল করলেন, মারিনার অঙ্গ-প্রতঙ্গ নাড়াচাড়া করার সময়ে দর্শকের হাতগুলো কখনও মারিনার বুকের ওপর আবার কখনও মারিনার তলপেট ছুঁয়ে যাচ্ছে। কখনও কনুই বা হাঁটুতেও লেগে যাচ্ছে সেই হাতগুলো। এইভাবে প্রায় এক ঘণ্টা কেটে যাওয়ার পর সেই হাতগুলোই যথেষ্ট সচেতন ভাবে মারিনার সারা দেহে ঘুরে বেড়াতে লাগল। মারিনাকে চুমু খেলেন একজন দর্শক। তারপর একজন মহিলা এসে মারিনার পুরো মুখে লিপস্টিক মাখিয়ে দিলেন। অন্য আরেকজন একটা মোমবাতি জ্বালিয়ে তার থেকে জ্বলন্ত মোম মারিনার শরীরের ওপর ফেলতে লাগলেন।
এত কিছুর পরও মারিনা শান্ত আছেন দেখে তাঁরা প্রায় অস্থির হয়ে উঠলেন। মারিনার জামা কাপড় খুলে নেওয়া শুরু হল এরপর। অবশ্য তাঁকে বিবস্ত্র করেই কিন্তু থেমে থাকেনি দর্শকের কৌতুহল। নগ্ন মারিনার বুকে, পেটে লেখা হল কদর্য গালাগালি। তার পরের দু ঘন্টায় চলল ‘অ্যাগ্রেভেটেড সেক্সুয়াল অ্যাসল্ট’। কেউ মারিনার যোনিতে আঙুল দিলেন। এমনকি সেখানে লোহার রড ঢোকানোর চেষ্টাও করেন কেউ। মারিনার স্তনদুটো দু’হাতে ডলতে শুরু করে, স্তন-বৃন্তে মুখ দিয়ে চোষার চেষ্টাও করলেন কেউ কেউ। দর্শকদের মধ্যে সবাই কিন্তু একই রকম ছিলেন না। এই ঘটনাটি অনেকেই দূরে দাঁড়িয়ে দেখছিলেন। মৃদু প্রতিবাদও করছিলেন কেউ কেউ। তবে পুরুষ-মহিলা নির্বিশেষে বেশিরভাগ মানুষই কিন্তু মারিনার উপর অত্যাচারই করে। শেষমেশ ছ’ঘন্টা হওয়ার পরেই সময় অতিক্রান্ত হয়। থামিয়ে দেওয়া হয় দর্শকদেরও। ঠিক যে অবস্থায় ছিলেন মারিনা, সেভাবেই চুপচাপ উঠে পড়েন মারিনা। দর্শকদের মধ্যে বেশ হইচই বেঁধে যায় তখন। মারিনা কিন্তু কাউকে একটা কথাও বলেননি। কিন্তু দর্শকদের কেউই মারিনার চোখে চোখ রেখে তাকাতে পারেননি আর।
এই প্রদর্শনীর পর নিজের ডায়েরিতে মারিনা লিখেছিলেন, এই প্রদর্শনীটির মাধ্যমে মানবজাতির এক ভয়ঙ্কর প্রবৃত্তির কথা তিনি বুঝতে পারেন। তিনি বলেন, সুবিধাজনক পরিস্থিতি থাকলে যে কেউ তোমাকে আঘাত করতে পারে। একজন নিরস্ত্র মানুষ যিনি নিজেকে বাঁচাতে পারবেন না, তাঁকে যে কোনো উপায়ে আঘাত করতেও পিছপা হয় না মানুষজন। এই কাজগুলি কিন্তু কোনো অপরাধী নন বরং খুব সাধারণ মানুষই করে থাকেন। আশ্চর্যের বিষয়, এগুলির জন্য তাঁরা কোনওরকম অনুতপ্তও হন না। অপরাধমূলক মানসিকতা তাদের মধ্যেও সমানভাবে বিরাজমান। মারিনা আব্রামোভিচ সত্যিই একজন জিনিয়াস ছিলেন। নিজের শরীর দিয়ে সমগ্র পৃথিবীর কাছে এক গভীর শিক্ষা দিয়ে গেছিলেন তিনি। বুঝিয়ে গেছিলেন, সাধারণ মানুষ থেকে ধর্ষক হতে খুব বেশি সময় হয়ত লাগে না। বরং মানুষের সাধারণ প্রবৃত্তির মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে এক ধর্ষকাম মানসিকতা। সত্যিই ভাবার বিষয়! নয় কি?
কলমে অনুভব দত্ত
Discussion about this post