ইতিহাসের গন্ধ মেখে নয় নয় করে ভালোই বয়স হল আমাদের সবার প্রিয় তিলোত্তমা নগরীর। বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপন করার লোভে কত যে জাতি, গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের মানুষ পা রেখেছেন এই নগরীতে তার কোনো ইয়ত্তা নেই। শুধু কি তাই? এ শহর দেখেছে ঔপনিবেশিকতার দুই শতক। এদের মধ্যে কেউ কেউ আবার থেকেও গেছেন, ছড়িয়ে ছিটিয়ে রেখে গেছেন তাঁদের অস্তিত্বের নানান নিদর্শন। জলপথের মাধ্যমে আসা এসব ভিনদেশীদের অবদানে কলকাতা আজ ‘সংস্কৃতির শহর’ বা ‘আঁতুরঘর’ ও বলা চলে। চলুন, এমনই এক ভিনদেশীদের কথা আজ বলা যাক।
জাতিতে তারা ছিলেন আর্মেনিয়ান। এসেছিলেন বাণিজ্যিক স্বার্থেই। বিশ্বাস করা হয় যে, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আগমনের আগেও খ্রিস্ট ধর্মের অস্তিত্ব ছিল এদেশে। এই বিশ্বাস আরো গাঢ় হয় আর্মেনিয়ানদের আসার পরেই। এনারা বেশ ধনী ছিলেন। নীল চাষ, দামি পাথরের অলংকার, জাহাজ, বস্ত্র—এসব থেকে শুরু করে অগুনতি ব্যবসা ছিল তাঁদের। ষোড়শ শতকে চুঁচুড়ায় ব্যবসাপত্তরের কেন্দ্র থাকলেও পরে কলকাতাই হয়ে ওঠে তাঁদের বসবাসের শহর।
কলকাতার রন্ধ্রে রন্ধ্রে মিশে আছে আর্মেনিয়ানদের সব জীবন্ত নিদর্শনগুলো। হাওড়া তথা কলকাতাবাসীর কাছে আর্মেনিয়ান ঘাট খুবই পরিচিত। হ্যাঁ ঠিকই ধরেছেন, এই ঘাট তাঁদের নামেই এবং জলপথে ব্যবসার সুবিধার্থেই এই ঘাটটি তৈরি করে তাঁরা। শুধু কি তাই? ব্রাবোর্ন রোডের কলকাতার প্রাচীনতম গির্জা আর্মেনিয়ান চার্চ, শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত গ্র্যান্ড হোটেল, বহু বাড়ি যেমন স্টিফেন কোর্ট, হোটেল কেনিলওয়ার্থ, কুইন্স ম্যানসন, পার্ক ম্যানসন সহ আরও অনেক কিছুর সঙ্গেই জড়িয়ে আছেন আর্মেনিয়ানরা। রেস কোর্সের রাজা জোহানস গলস্তাউন কলকাতায় প্রায় ৩৫০টি অট্টালিকা বানান। রেসকোর্সে দাপিয়ে বেড়াত তাঁর দেড়শো ঘোড়া। নিজে থাকার জন্য তৈরি করেন নিজাম প্যালেস। সেই সময় ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল-এর জন্য দান করেছিলেন ২৫ হাজার টাকা।
স্থাপত্যেগুলোর পিছনে তাঁদের গল্পগুলো সবই এখন অতীত। সেসময় তাঁরা সংখ্যায় ৩০ হাজার হলেও এখন খুবই কম সংখ্যক মানুষ রয়েছেন এ শহরে। তাঁদের ঠাঁই এখন পার্ক সার্কাসের ‘স্যর ক্যাথিক পল চ্যাটার হোম ফর দ্য এল্ডারলি’ নামে এক বৃদ্ধাশ্রমে। আর্মেনিয়ানরা ২৫শে ডিসেম্বর ক্রিসমাস পালন করেন না। ফাদার আর্ডসার্নের মতানুযায়ী ৬ই জানুয়ারি যীশুর জন্মদিন ও ব্যাপটিজম-এর দিন একই সঙ্গে পালন করে আর্মেনিয়ান অর্থোডক্স চার্চ। বস্তুত চতুর্থ শতকের আগে পর্যন্ত খ্রিস্টানরা এই সময়েই বড়দিন পালন করত। পরে ক্রিসমাসের দিন পালটালেও আর্মেনিয়ানরা নিজেদের ঐতিহ্য ও বিশ্বাস থেকে সরে আসেননি।
অবশেষে বলা যায় একরাশ স্মৃতি সঙ্গে নিয়ে বেঁচে আছেন আর্মেনিয়ানরা। আর্মেনিয়া দেশটা এদের কাছে অনেকটা রূপকথার মতো। তাঁরা নিজের আত্মীয়- পরিজনের কাছ থেকে শুধু শুনেছে এই দেশটার ব্যাপারে। কিন্তু এখন এই দেশ বা এই শহরই ওনাদের অস্তিত্ব, ওনাদের ভালবাসা। তাঁরা তাঁদের শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত কলকাতাতেই থেকে যেতে চান।
Discussion about this post