বসন্তে দোলের হাওয়ায় মিশে থাকে রাধাশ্যামের নাম। শ্রী রাধিকা আর কৃষ্ণকে ছেড়ে প্রেমের কথা ভাবেন এমন মানুষ কমই আছে। আর এমনই এক রাধা কৃষ্ণের মিলনের সাক্ষী আড়ংঘাটার যুগল মন্দির। গঙ্গারাম নামে এক মহন্ত শ্রী কৃষ্ণের কিশোর বেলার এক মূর্তি নিয়ে আসেন বৃন্দাবন থেকে। নবদ্বীপের কাছে সমুদ্রগড়ে চলতো এ মূর্তির নিত্য পুজো। কিন্তু বর্গী হানার কারণে এই মূর্তি নিয়ে গঙ্গারাম চলে আসেন নদিয়ার রাণাঘাট মহকুমার আড়ংঘাটায়। এখানে তাঁরই স্বদেশী বন্ধু রামপ্রসাদের দ্বারস্থ হন তিনি। রামপ্রসাদ ছিলেন মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের কর্মচারী।
ভগবানের প্রতিষ্ঠা তার ইচ্ছে ছাড়া তো হবার নয়। আর তিনি স্বপ্ন ছেড়ে কবেই বা স্বয়ং এলেন! গঙ্গারাম স্বপ্নাদেশ পান স্বয়ং শ্রী কৃষ্ণের। কৃষ্ণ বলছেন, ‘আমার শ্রী রাধিকা আছে মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের কাছে।’ এ স্বপ্নাদেশের বার্তা মহারাজের কাছে বয়ে যায় রামপ্রসাদেরই মাধ্যমে। এর কিছুদিন পর মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র স্বপ্নাদেশ পান, ‘বাড়ির ভূ-গর্ভস্থ স্থানে কিশোরী শ্রী রাধিকার ধাতব মূর্তি রয়েছে।’ মহারাজের তত্ত্বাবধানে শ্রী রাধিকার মূর্তি উদ্ধার করা হয়। মহারাজ স্বয়ং রাধিকাকে সঙ্গে নিয়ে বজরা করে চলে আসেন আড়ংঘাটায়।
বর্তমান মন্দির প্রাঙ্গণে বকুল গাছের নীচে প্রতিষ্ঠিত হয় শ্রীকৃষ্ণ এবং শ্রী রাধিকার যুগল। মহারাজ নিজে হাজির থেকে পুরোহিত দিয়ে মহা আড়ম্বরে পুজো করান। এই যুগল মূর্তি প্রতিষ্ঠা থেকেই মন্দিরের নাম হয় ‘যুগল মন্দির’। তবে এ মন্দির রাতারাতি গড়ে ওঠেনি। নিত্য পুজোর জন্য মহারাজ দেবোত্তর সম্পত্তির একশো পঁচিশ বিঘা দান করেন। সময় বয়ে এসে ১৭২৮ সালে আড়ংঘাটায় প্রতিষ্ঠিত হয় মন্দিরের পঙ্খ। অলংকৃত ও পাঁচটি ফুল কাটা খিলানের দুই সারি যুক্ত প্রশস্ত দালান মন্দির। যুগল কিশোরের স্থান সিংহাসনে, যা পুরো পরিবেশকে আলোকিত করে রাখে।
মন্দির প্রাঙ্গণে গেলে মন যেমনি শান্ত হয়, তেমনি এখানে ধরা পড়ে পুরাণের ছোঁয়া। দু’পাশের দেওয়াল জুড়ে দশাবতারের চিত্র। যে ছবি বারবার স্মরণ করায় বাংলার লোকসংস্কৃতির কথা। প্রাঙ্গণের চার কোণে চারটি তুলসী মঞ্চ রয়েছে বৈষ্ণব সংস্কৃতির অংশ স্বরূপ। আর মন্দির চত্বরে ৩০০ বছরের পুরনো বকুল গাছ, যা কিনা পরিচিত ‘সিদ্ধ বকুল’ নামে। প্রতি বছর জৈষ্ঠ মাসের মেলায় সাধু সমাগম যে লেগেই থাকে বলাই বাহুল্য। পূর্ণদাস বাউল আর তার সম্প্রদায় আসতেন বাউল গান পরিবেশন করতে। শোনা যায়, যুগল কিশোর দর্শনে মহিলারা অনাথিনী হন না। এ প্রার্থনা মনে নিয়েই ভিড় জমান মহিলারা। আর এ ভিড়ে সামিল ছিলেন’ পথের পাঁচালীর’ সর্বজয়াও।
Discussion about this post