‘বইপ্রেমী’, ‘বইপোকা’ বিশেষণ গুলো ভীষণরকম পরিচিত। উপযুক্ত বিশেষ্য ব্যতীত বিশেষণগুলি অস্তিত্বহীন। পঞ্চ ইন্দ্রিয় খোলা রাখলে খোঁজ পাওয়া যায় এমন অনেক বইপ্রেমীদের যারা বই পড়া এবং সংগ্রহ করাকে একপ্রকার নেশার পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছেন!
আজ থেকে ১২-১৩ বছর আগে একটি সর্বভারতীয় দৈনিকে প্রকাশিত প্রতিবেদনের বিষয় ছিল কলকাতার প্রাইভেট লাইব্রেরির সন্ধান। সেখানে মোট তিনজন ব্যক্তির কথা তারা উল্লেখ ছিল। উৎপল দত্ত, সুধীন চট্টোপাধ্যায় ও অঞ্জন চক্রবর্তী। এঁদের মধ্যে সেই সময় শুধুমাত্র অঞ্জন চক্রবর্তীর সংগৃহীত বইয়ের সংখ্যাই ছিল ৩৫ হাজার! এখন তো সেই সংখ্যা ছাড়িয়ে গিয়েছে কবে! অঞ্জন চক্রবর্তীর একজন বন্ধু ছিলেন যিনি জাতীয় গ্রন্থাগারের গ্রন্থাগারিক। তিনি অঞ্জনবাবুর বই সংগ্রহের তালিকা দেখে রীতিমতো থ! বাড়িতে যতগুলো বই আছে সেসব ঠিকঠাকভাবে গুছিয়ে রাখতে কুড়ি খানা ঘরের প্রয়োজন। কিন্তু তিনি সব বই কোনোরকমে দোতলার পাঁচটি ঘরে রেখেছেন! সেই ঘরগুলোতে হাঁটা চলা তো দূর অস্ত, সেখানে প্রবেশ করাও রীতিমতো এক কসরত! এমনই বইয়ের প্রতি নেশা ছিল অঞ্জনবাবুর।
অঞ্জনবাবুর পরিচয়? পুরো নাম অঞ্জন চক্রবর্তী। জন্ম ১৯৪১-এর ৪ সেপ্টেম্বর ঢাকায়। বর্তমান ঠিকানা বিজয়গড়। একসময় নেতাজীনগর বিদ্যামন্দিরে ইতিহাস ও ইংরেজিতে শিক্ষকতা করেছেন। ব্যারাকপুরের সুরেন্দ্রনাথ কলেজেও কিছু সময়ের জন্য শিক্ষকতা করেছেন। তবে এই পরিচয় বাদ দিলেও বইপ্রেমীদের আখড়ায় তাঁর এক ভিন্ন পরিচয় আছে। একসময় গোলপার্কের বইয়ের দোকান আর কলেজ স্ট্রিটে তাঁর যাতায়াত ছিল অবাধ। এখন বয়সের ভারে যাতায়াত কমেছে ঠিকই। কিন্তু আজও অঞ্জন চক্রবর্তীর নাম বললে গোলপার্কে সকলে এক ডাকে চেনে। অঞ্জনবাবুর বই কেনা ও পড়ার এক মারাত্মক নেশা ছিল। ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্টের খবরের কাগজ সংগ্রহ করা থেকে যে কোনো বিষয়ের দুলর্ভ বই, সবই তাঁর সংগ্রহে। মাঝে মাঝে এমনও হয়েছে তিনি বাড়ি থেকে বিজয়গড়ের বাজারে গিয়েছেন সাইকেল চেপে। কিন্তু বইকেনার নেশায় সাইকেল বাজারে ফেলে বাসে চেপে সোজা গোলপার্ক। ফিরে এসে দেখলেন সাইকেল উধাও! বই নিয়ে দোকানদারের সাথে দর কষাকষিকে তিনি একপ্রকার শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। ২০০ টাকার বই কিনেছেন ২০ টাকায়! তবে হ্যাঁ, বই তিনি কাউকে দিতে চান না। বই দিলে ফেরত না দেওয়ার অভিজ্ঞতা থাকায় তাঁর এই প্রতিজ্ঞা।
তবে এই বইয়ের প্রতি পাগলামিতে তিনি পাশে পেয়েছিলেন তাঁর পরিবারকেও। বেতনের অর্ধেক মাইনে যে বই কিনতেই খরচ হয়ে যায়। এই নিয়ে কোন দিনও আপত্তি করেননি তাঁর স্ত্রী অরুন্ধতী চক্রবর্তীও। মা-বাবার সহযোগিতাও পেয়েছেন চিরকাল। বলতে গেলে তাঁর পরিবারে ‘বইপ্রেমী’ ধারাটা যেন খানিক বংশানুক্রমিক। নাহ্, অঞ্জনবাবুর বাবা অমিয়ভূষণ চক্রবর্তীর হয়তো বইকে ঘিরে এত পাগলামি ছিল না। তবে তাঁর কীর্তিকলাপেও রয়েছে বইয়ের ছোঁয়া। বাচ্চাদের জন্য তৈরী করেছিলেন একটি স্কুল, নাম ‘শিশুর দেশ’। অঞ্জনবাবুর স্ত্রী অরুন্ধতী চক্রবর্তীর সম্পূর্ণ নিজস্ব চেষ্টায় এই স্কুলটি এখনো দাঁড়িয়ে আছে সসম্মানে।
হ্যাঁ, প্রসঙ্গে ফেরা যাক। বর্তমানে তাঁর বইয়ের তালিকা হার মানিয়ে দিতে পারে বইয়ের দোকানকেও। তাই তাঁর পরিবার বিজয়নগরের বাড়িতে ব্যবস্থা করেছে একটি লিভিং সেন্টারের। শর্ত একটাই বই পড়ে রেখে দিতে হবে যথাস্থানে। তবে অঞ্জনবাবুর বইয়ের প্রতি এই পাগলামি নিয়ে যে যাই বলুক। সৈয়দ মুজতবা আলী তো সেই কবেই বলেছেন, “বই কিনে কেউ দেউলিয়া হয়না।”
Discussion about this post