হুগলির আনাচে কানাচে আজও ইতিহাসেরা কথা বলে। তারমধ্যে কিছু তথ্য সবারই জানা। আবার এমন কিছু নিদর্শন রয়েছে যাদের সাথে জড়িয়ে হাজার অজানা কাহিনী। আজ তেমনই এক চেনা অচেনার সাথেই আলাপ করাব আপনাদের। শ্রীরামপুর স্টেশনের পশ্চিম পাড়ের লেভেল ক্রসিং পেরিয়ে অটোতে ২০ মিনিটের রাস্তা। শ্রীরামপুরের এক্কেবারে প্রান্তে বাঙ্গিহাটীতে সগৌরবে মাথা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে ৫০০ বছরের পুরোনো (মতান্তরে ৩০০ বছর) এক শিবমন্দির। আর এর সঙ্গে জড়িয়ে এক অজানা গল্পকথা।
নিঃসন্তান রাজা রুদ্রপ্রসাদ চৌধুরী কাশী বিশ্বনাথ দর্শনের উদ্দেশ্যে বেরিয়েছেন। মাঝরাতে নৌকা তখন শেওড়াফুলির ঘাটে। ঘুমের মধ্যে রাজা দেখা পেলেন স্বয়ং মহাদেবের। বাঙ্গিহাটিতে বারো মন্দিরের প্রতিষ্ঠা করতে হবে এমনই আদেশ দেন মহাদেব। এমনকি সেবক হিসেবে মহাদেব আঁড়িয়াদহের ব্রাহ্মণ শ্রী দীননাথ চট্টোপাধ্যায়কেই নিয়োগের নির্দেশও দেন। কাশীর দিকে আর না এগিয়ে পরদিনই রাজা রওনা দিলেন বাঙ্গিহাটির পথে। ঘন জঙ্গলে ঘেরা বাঙ্গিহাটি তখন দস্যুদের আখড়া। সেসব উপেক্ষা করেই রাজা এগিয়ে চলেছেন। হঠাৎই একটি জায়গায় গিয়ে গাড়ির চাকা মাটিতে গেল আটকে। কোনোভাবেই তাকে আর চালানো গেল না। রাজা বুঝতে পারেন এ নিশ্চয়ই কোনো দৈব নির্দেশ। তাই সেই অঞ্চলেই গড়লেন বারোটি একসারির শিবমন্দির।
মন্দিরের শিবলিঙ্গগুলি সুদূর রাজস্থান থেকে আনা। লক্ষ্য করলে দেখা যায় মন্দিরের ইটগুলো বড় থেকে ছোট আবার ছোট থেকে বড় করে কলসীর ধাঁচ দেওয়া হয়েছে। শামুকের খোল থেকে চুন তৈরী করে ব্যবহার হয়েছে এই মন্দিরে। দরজাগুলো সেগুন কাঠের তৈরী। ব্রাহ্মন সেবক দীননাথবাবু সত্যিই এক অমায়িক ও স্বার্থহীন ব্রাহ্মণ ছিলেন। তাই রাজার প্রিয় হয়ে ওঠেন খুব তাড়াতাড়ি। দীননাথবাবুকে রাজা খুশি হয়ে তাই শতাধিক জমি ও ‘চক্রবর্তী’ উপাধিও দিয়েছিলেন। সেই পুরোহিতের ভক্তিকে কেন্দ্র করেই ধীরে ধীরে মন্দিরের চারপাশে গড়ে ওঠে জনবসতি। ১৩৮৫ বঙ্গাব্দে মন্দিরের লাগোয়া দক্ষিণা কালি মন্দির এবং রাধা গোবিন্দ জিউর মন্দির স্থাপন করেন দীননাথবাবুর বংশধর ডঃ কালিদাস চক্রবর্তী। এখনও এই মন্দিরের সেবা ভার দীননাথবাবুর উত্তরপুরুষদের উপরই রয়ছে। বর্তমান সেবক সুব্রত চক্রবর্তী মনে করেন এত বছরের পুরোনো এই মন্দিরটিকে ‘হেরিটেজ সাইট’ সম্মান দেওয়া উচিৎ। কিন্তু এখনও পর্যন্ত মন্দিরটি হেরিটেজ হয়ে উঠতে পারেনি। কারণ আজও যে সবার অগোচরে বাঙ্গিহাটীতে শ্বাস ফেলে চলেছে সে।
Discussion about this post