সে পুরুষ হোক কিংবা নারী নিজেকে সুন্দর দেখাতে কে না চায়? আজকাল নিজেকে আরও বেশী আকর্ষণীয় করে তুলতে প্রায় সকলেই ব্যবহার করেন নানান ধরনের প্রসাধনী। আবার নিজেকে আরও সুন্দর করে তুলতেই অনেকে বদলে ফেলেন মুখ বা শরীরের অন্যান্য অঙ্গের গঠনও। এইভাবে নিজেকে সুন্দর ও আকর্ষণীয় করে তোলার ঐতিহ্য কিন্তু আমাদের প্রাচীন ভারতেও লক্ষ্য করা গিয়েছে। বিভিন্ন বহুল প্রচলিত প্রসাধনী সামগ্রীর অস্তিত্ব মেলে ইতিহাসের পাতায়।
প্রাচীনতম সভ্যতা হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারো সভ্যতায় নারী-পুরুষ উভয়েই ব্যাবহার করতেন প্রসাধনী। যদিও তা তৈরী হতো সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক ভাবেই। তাদের ব্যবহৃত প্রসাধনীর তালিকায় ছিল ফেস পেন্ট, পাউডার, কাজল ইত্যাদি। যার প্রমাণ মেলে নানা প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনে। হাতির দাঁত দ্বারা নির্মিত বিভিন্ন ধরনের চিরুনি, তাদের শৌখিনতাকেই প্রকাশ করে। তবে এটি যে তারা কেবল নিজেকে শুধু সুন্দর করে তুলতেই ব্যাবহার করতেন না, তা কিন্তু নয় । এর পিছনে ছিল পূণ্য, আরোগ্য এমনকি আনন্দ লাভের তীব্র ইচ্ছাও।
এখন নিজেকে ফর্সা করে তুলতে বাজারে মেলে দামী ক্রিম- পাউডার। তেমনই চুলের ঘনত্ব বৃদ্ধি বা যত্ন নেওয়ার জন্যে আছে নানান তেল – শ্যাম্পু। কিন্তু এগুলোও ভারতের ইতিহাসের নিরিখে নতুন কোনো বিষয়ে নয়। ত্বক হোক বা চুল, সবকিছুরই বিভিন্ন টোটকার উল্লেখ মেলে চরক-সংহিতা, আর্থশাস্ত্রর মত বিখ্যাত গ্রন্থে। যেমন অর্থশাস্ত্রে বলা আছে যে কেউ যদি স্বতভারি, কৌস্তকী গাছের মূল থেকে তৈরী পাউডারের সংমিশ্রণ একমাস খান তাহলে তার গায়ের রঙ হবে আরো ফর্সা । আবার এখানে এক ধরনের তেলের কথাও আছে। যা সাতদিন ব্যাবহার করলে নাকি চুলের রঙ পরিবর্তন করাও সম্ভব। এছাড়াও সে যুগের নারীরা হলুদ, বেসন, মাখন ইত্যাদি ব্যাবহার করতেন ত্বকের যত্ন নেওয়ার জন্য। বর্তমানে নিজেকে আরও আকর্ষণীয় করতে মুখের গঠন বদলানোর এক প্রবণতা লক্ষ্য করা যায় । এরও হদিশ মেলে খ্রীষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতব্দীতে সুশ্রুত দ্বারা রচিত সুশ্রুত সংহিতাতে। সুশ্রুত সংহিতায় বিভিন্ন ধরনের প্লাস্টিক সার্জারির বিস্তৃত বিবরণ আমরা পাই।
কেবলমাত্র ত্বকের রং পরিবর্তন বা গঠনগত পরিবর্তনই নয়, নিজেকে আরও আকর্ষণীয় করে তোলার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত সুগন্ধী বা ‘সেন্ট’। এই সুগন্ধী প্রস্তুতির খোঁজও মেলে সেই ইতিহাসের পাতাতেই। ১৫০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে রচিত ঋগবেদে বলা আছে বিভিন্ন সুগন্ধী গাছের কথা। সেগুলোর থেকে পাওয়া তেল আয়ুর্বেদে ব্যাবহার করা হত যাকে বলা হত ‘গন্ধযুক্তি’ বা ‘গন্ধপজিবিনা’। খ্রীষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে বরাহমিহির তাঁর বৃহৎ সংহিতায় গোটা একটি অধ্যায় লেখেন সুগন্ধীর ওপর। এখান থেকে জানা যায় সুগন্ধী প্রস্তুতকারকরা কীভাবে মাত্র ১৬টি উপকরণকে বিভিন্ন পরিমাণে মিশিয়ে নানারকম সুগন্ধী তৈরী করতেন। যার সংখ্যা ছিল প্রায় ১ লক্ষ ৭৪ হাজার ৭২০ টি।
এর থেকেই বোঝা যাচ্ছে যে আজকাল প্রসাধনীর এই বিপুল চাহিদা ও নিজেকে সুন্দর দেখানোর চেষ্টা এক প্রাচীনতম প্রবৃত্তির বহিঃপ্রকাশ মাত্র।
Discussion about this post