খ্রিস্টানদের মড়া পোড়ানো! শুনলে কেমন একটা লাগে, তাই না? খ্রিস্টধর্মে তো মৃতদেহ কবর দেবার কথা বলা হয়েছে, তাহলে এই পোড়ানোর প্রশ্ন আসছে কোথা থেকে! আমাদের কাছে যদিও এটা খুবই অচেনা একটা ঘটনা, তবুও পাশ্চাত্যের দেশগুলোতে এটা খুবই সাধারণ বিষয়। ওই দেশগুলোতে কবর দেবার জায়গায় এতটাই অভাব, তাই কবরের জমি খুবই দুর্মূল্য! তাই সেই টানাটানির বাজারে, খরচ বাঁচাতে মৃতদেহটিকে পুড়িয়ে সেই ছাই একটা ধাতব বা চিনামাটির পাত্রে করে নিয়ে, কোনো ছোট একটা জায়গায় কবর দেওয়া হয়।
এবার কথা ওঠে, কলকাতায় তো এরকম কোন সমস্যা নেই, তবে এখানেও পোড়ানোর কি দরকার। দরকারটা অন্যরকম। ধরে নেওয়া যাক, মিস্টার এক্স বিলেত থেকে এদেশে চাকরি করতে এসে, অকালে মারা গেলেন। তার পরিবারের লোকজন চাইছেন, জন্মভূমিতে ওনাকে সমাহিত করা হোক। কিন্তু, কলকাতা থেকে বিলেতে মৃতদেহ অবিকৃত অবস্থায় নিয়ে যাওয়া হবে কি করে! তাই এর সহজ সমাধান হলো, মৃতদেহকে পুড়িয়ে ছাই করে নিয়ে, সেই ছাই ধীরে-সুস্থে বিলেতে নিয়ে গিয়ে কবর দেওয়া! এই প্রয়োজন থেকেই, খ্রিস্টিয়ান বুরিয়াল বোর্ড সিদ্ধান্ত নেয়, একটা চুল্লি গড়ে তোলা হবে কলকাতায়। বেছে নেওয়া হয় জেনারেল এপিস্কোপাল সেমেটারির অর্থাৎ লোয়ার সার্কুলার রোড সেমেটারির পিছনের একটা জায়গা।
মোটামুটি ১৯০৪ খৃস্টাব্দ নাগাদ এই চুল্লি বানানো শুরু হয়, আর উদ্বোধন হয় ১৯০৬ নাগাদ, নাম দেওয়া হয় ‘Christian Gas Crematorium’… সেই অনুযায়ী সামনের রাস্তার নামও হয়ে যায় ‘Crematorium Street‘। এখানে ইংরেজদের ছাড়াও, ব্রাহ্মদেরও দাহ করা হতো, কারণ ব্রাহ্মরা গঙ্গার ধারে শবদাহ করতে ইচ্ছুক ছিলেন না। তারপর সেই ছাই নিয়ে তারা সমাধিস্থ করতেন। আর কিছু কিছু ক্ষেত্রে, যেসব এদেশীয়রা খ্রিস্টধর্মে ধর্মান্তরিত হতেন, তাদের মধ্যে অনেকের বাড়ির লোকজন দাবি করতেন এখানে মৃতদেহ পুড়িয়ে, সেই ছাই কবর দেওয়ার। চুল্লি রাখার জন্য একটা চিমনিওলা বড়ো হলঘর বানানো হয়, যার সামনে একটা ছোট বারান্দা আছে। এই বারান্দায় আবার একটা উঁচু বেদী আছে, যেখানে মৃতদেহ চুল্লিতে ঢোকানোর আগে রাখা হত।
চুল্লিটি বানিয়েছিল একটি ফ্রেঞ্চ কোম্পানী, নাম ‘Toisoul Fradet & Co’, যারা সেই সময়ে গ্যাস চুল্লি বানানোর বিষয়ে বেশ বিখ্যাত ছিল। মোটামুটি ১০ ফুট লম্বা এই চুল্লিটির দুই দিকেই দরজা আছে, আর একটা ধাতব সিঁড়ির মতো দেখতে ট্রের মাধ্যমে মৃতদেহ চুল্লিতে ঢোকানো হয়। চুল্লির ভিতরে গ্যাসের পাইপের অনেকগুলো মুখ রয়েছে। এছাড়াও চুল্লিতে আগুন জ্বলার সময়ে, ভিতরের অবস্থা দেখার জন্য ছোট ছোট ঢাকনাওলা ফুটো রয়েছে চুল্লির বাইরের দুদিকের দেওয়ালে। তৈরী করার কিছুদিন পর থেকেই এই গ্যাস চুল্লি বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। স্যার জগদীশ চন্দ্র বসু ব্রাহ্ম ছিলেন, তাই ওনাকেও এখানে দাহ করা হয়েছিল। আর একটা ঘটনা কানাঘুষো শোনা যায় যে, কোলকাতায় যখন প্লেগের মহামারী ঘটে, কিছু প্লেগে মৃত ইংরেজকে এখানে দাহ করা হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীকালে স্থানীয় মানুষদের চাপে, এই কাজ বন্ধ করা হয়। মজার কথা হলো, খ্রিস্টিয়ান বুরিয়াল বোর্ড এই কথা একদমই স্বীকার করে না। এটি মোটামুটি ১৯৮০ সাল পর্যন্ত চালু ছিল। কিন্তু এর পরেই অনিয়মিত গ্যাসের যোগান, কলকাতায় বন্যা প্রভৃতি বিভিন্ন কারণে এই চুল্লি পরিত্যক্ত হয়। বর্তমানে এখানে ঢুকতে হলে বুরিয়াল বোর্ড থেকে অনুমতি নিতে হয়।
চিত্র ঋণ – রঙ্গন দত্ত
Discussion about this post