বাংলাদেশের চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার নাচোল একটি উপজেলা। একসময় এই নাচোল ছিল তেভাগা আন্দোলনের প্রাণকেন্দ্র। দেশভাগ তখনও হয়নি। জমিদার জোতদারদের দিনের পর দিন অরাজকতার প্রতিবাদে কৃষক ভাগচাষিরা শুরু করে বিদ্রোহ, তেভাগা আন্দোলন। কৃষকদের দাবি ফসলের দুই তৃতীয়াংশ ফিরিয়ে দিতে হবে তাদের। আর এই দাবিতেই ‘রাণী মা’ অর্থাৎ নেত্রী ইলা মিত্র টিকইল গ্রামের মানুষজনকে একজোট করে বিদ্রোহ চালিয়ে যান একটানা। রাণীমার স্মৃতি সমৃদ্ধ সেই ছোট্ট গ্রাম হল টিকইল। যেখানে আজ পা রাখলে চোখে পড়বে রঙবেরঙের আলপনার বাহার।
ঝাড়গ্রামের ‘খোয়াব গাঁ’ নিয়ে তো জল্পনার শেষ নেই। দেওয়াল ক্যানভাসে রঙতুলির সেই নান্দনিক শিল্পের কারুকার্য সত্যিই স্বপ্নের মতো। কিন্তু শুধু এপার বাংলা নয় ওপার বাংলার তেমনই এক রঙীন গ্রাম হল এই গ্রামটি। যার আজকের পরিচিত ডাকনাম ‘আলপনা গ্রাম’।
প্রতিদিনই সাজতে ভালোবাসে খোয়াব গাঁ, মাটিলেপা দেওয়ালটাই যেন ক্যানভাস! (dailynewsreel.in)
প্রায় দেড়শ বছর ধরে হিন্দু সম্প্রদায়ের বাস এই গ্রামটিতে। কিন্তু সব বাড়ির দেওয়াল জুড়ে এমন রাশি রাশি আলপনা কেন এটাই ভাবছেন তো? আসলে বাসিন্দাদের ভক্তিই হল এই শিল্পকলার উৎসস্থল বলা যায়। বাড়ির দেওয়াল জুড়ে আলপনার উপস্থিতি নাকি পবিত্রতা ও শান্তি আনে। বছরে দু’বার লক্ষ্মী পূজা ও দুর্গা পূজায় বাড়ি সাজানো হয়। যখনই এখানে কোনো উৎসব বা পার্বনহয় তখনই চলে বাহারি আলপনার রকমারি নকশা। স্থানীয় বাড়ির মেয়েরা দেওয়াল জুড়ে এঁকে চলে রঙীন আলপনা। প্রথমের দিকে চক, খড়িমাটি, গিরিমাটি, রং এবং তারপিন তেল ব্যবহার হত। তবে তার স্থায়ীত্ব বেশিদিন ছিল না। আর এখন সেখানে আম আঁটির শাঁস চূর্ণ,শুকনো বড়ই, চকগুঁড়া, মানকচু ও কলাগাছের কষ ৪-৫ দিন ভিজিয়ে রেখে বিভিন্ন রঙের সঙ্গে মিশিয়ে তৈরী হয় আলপনার প্রধান কাঁচামাল। এতে আলপনাটি টেকে বহুদিন। আর এই নব নব সাজের জন্য বছরে প্রায় ১২-১৩ হাজার টাকা হয় খরচ। প্রতিটা বাড়ির আনাচে কানাচেই খুঁজে পাবেন অপূর্ব সব শিল্পশৈলী! আবার মজার বিষয় হল, আগেরদিনে কোন বাড়ির সাথে বিয়ের সম্বন্ধ হবে তা ঠিক হত বাড়ির শৈল্পিকতার রুচি দেখেই।
নান্দনিক সৃষ্টি সুখের উল্লাসে দেওয়াল জুড়ে আজও আঁচড় কাটা হয় আলপনার। এই গ্রামটির আবেগের সাথে ঐতিহ্যের মেলবন্ধনই হল এই আলপনা। ভবিষ্যতে হয়ত মাটির বাড়ি সরে ইঁটের পাঁজর ঘেরা পাকাবাড়ি হবে। কিন্তু তখনও এই ঐতিহ্যের সাথে অবহেলা হবে না কোনোদিনই।
সম্পাদনা – অনন্যা করণ
Discussion about this post