৩২ নং আলিমুদ্দিন স্ট্রিট, এটা পশ্চিমবঙ্গবাসীর কাছে অতিপরিচিত এক ঠিকানা। ২০১১ এর আগে দীর্ঘ ৩৪ বছর এখানে বসেই গোটা রাজ্যপাটের দায়িত্ব সামলেছে তৎকালীন ক্ষমতাসীন দল কমিউনিস্ট পার্টি অফ ইন্ডিয়া ওরফে সিপিআই(এম)। আজও এইখানেই তাদের সদর দফতরে ওড়ে লাল পতাকা। কিন্তু যাঁর নামে এই রাস্তার নামকরণ সে ক্রমেই ইতিহাসের পাতা থেকে বিবর্ণ হতে হতে কেবল একটি ঠিকানাতে পরিণত হয়েছে। কিন্তু সৈয়দ আলিমুদ্দিন আহমেদ ওরফে মাষ্টার সাহেব, যাঁর নামেই এই রাস্তার নামকরণ তিনি ছিলেন বাংলার স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম মুখ।
সৈয়দ আলিমুদ্দিন আহমেদের ১৮৮৪ সালে ঢাকার আকাশ জমাদার লেনে জন্ম হয়। তিনি বিপ্লবী হেমচন্দ্র ঘোষের সতীর্থ ছিলেন। ঢাকার আব্দুল গনি সাহেবের ফ্রি স্কুলে তাঁদের প্রাথমিক পাঠ শুরু হয়। তৃতীয় শ্রেণি পাঠান্তে হেমচন্দ্র অন্যত্র পড়তে চলে যান। আর আলিমুদ্দিন স্থানীয় মাদ্রাসাতে ভরতি হন। মাদ্রাসার পাঠ শেষ করে ১৯০৬ সালে ঢাকা কলেজে ভরতি হন। তবে আর্থিক দূর্দশার কারণে এফ এ পরীক্ষা দিতে পারেন নি। অর্থাভাবে একটি চাকরি করতে শুরু করেন, আর তার মাঝেমাঝে চলত ছাত্র পড়ানো। এই থেকেই তিনি “মাষ্টার সাহেব।”
এরপর, আলিমুদ্দিন নিজে শরীর চর্চা, লাঠি চালনা ইত্যাদি প্রশিক্ষণের উদ্দেশ্যে একটি আখড়া তৈরি করেন। ছাত্র পড়ানো, চাকরির মাঝেও আলিমুদ্দিন ভোলেননি দেশের প্রতি তার কর্তব্য। প্রথম থেকেই তাঁর বিপ্লবী মানসিকতা ছিল। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন পুরোদমে শুরু হয়ে গিয়েছে। সেই সময় বিপ্লবী হেমচন্দ্র প্রতিষ্ঠা করলেন এক গুপ্ত সমিতি, সেখানকার প্রধান সদস্য ছিলেন আলিমুদ্দিন। আখড়ায় প্রশিক্ষিত যুবকদের নিয়ে এমন ভাবে ব্রিটিশদের বোকা বানিয়ে অতি সংগোপনে ব্রিটিশ বিরোধী ধ্বংসাত্মক সংগ্রাম পরিচালনা করতেন যা সরকার কোনভাবেই বুঝতে পারেনি। আলিমুদ্দিন প্রতিষ্ঠিত সংগঠন ‘মুক্তিসংঘ’ ও ‘ভলান্টিয়ার ক্লাব’ বহুবিধ দুঃসাহসিক বৈপ্লবিক কাজ কর্ম চালিয়ে যেত। ধর্মনিষ্ঠ মাষ্টার সাহেবকে পুলিশ কোনওদিনই বিপ্লবী বলে আন্দাজ করতে পারেনি। সেটাই ছিল তাঁর জন্য মস্ত সুবিধা।
তারা কখনো বড়লোকেদের কাছে হয়ে উঠেছিল ডাকাত, গরীবদের কাছে হয়ে উঠেছিল ত্রাতা। বিপ্লবের কাজে প্রয়োজনীয় অর্থ সাহায্য করার জন্য আলিমুদ্দিন গঠন করেছিলেন স্বদেশি ডাকাতদল। সেই যুগেই পুঁজিপতিদের ত্রাস হয়ে উঠেছিল তাঁরা। ইংরেজ সরকারের দমননীতির ফলে হেমচন্দ্র সহ একাধিক নেতা যখন জেলে, তখনও ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনকে অক্সিজেন জুগিয়েছেন আলিমুদ্দিন। ১৯২০ সালে যক্ষ্মা রোগে বেশ কিছুদিন ভোগার পর চলে গেলেন মাস্টার সাহেব। পরবর্তীকালে তার নামানুসারে মধ্য কলকাতার একটি রাস্তার নামকরণ করা হল ‘আলিমুদ্দিন স্ট্রিট।’ মাস্টার সাহেবের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে শেষ হল ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে এক বর্ণময় অধ্যায়।
Discussion about this post