যন্ত্র দিয়ে গাছ কাটার শব্দে বিরক্ত, অতিষ্ঠ হয়ে বুনো হাতিরা জঙ্গল থেকে বেরিয়ে লোকালয়ে এসে বাড়িঘর ভেঙে ফেলছে, এই বছরের জানুয়ারি মাসে বুনো হাতির পায়ের তলায় পিষে মারা গেছে মানুষ, দৈনন্দিনের ব্যবহারের জল পাওয়া যেত যে নদী থেকে; সেই নদীর জল পরিণত হয়েছে বিষে, ছোটো শিশুরা গাছপালার সঙ্গে নিজেদের বাসস্থানকেও গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে যেতে দেখছে হাতির পায়ের তলায় – এই সমস্ত ঘটনা ছত্তিসগড়ে ঘটে চলেছে বিগত প্রায় এক দশক ধরে। কারণ? ছত্তিসগড়ের হাসদেও আরন্ড জঙ্গল সাফ করে দেওয়া হচ্ছে কয়লা খননের জন্য।
সারা ভারতে টিকে থাকা বৃহৎ অরণ্যগুলির মধ্যে অন্যতম অখন্ড অরণ্যভূমি হল হাসদেও আরন্ড। ভারতের ঠিক মধ্যবর্তী অংশে এই অরণ্যের অবস্থান। গভীর এই অরণ্য হাতি, চিতা, ভাল্লুকসহ অন্যান্য অসংখ্য বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল। এছাড়াও রয়েছে বিপুল জলসম্পদ। আছেন এখানকার আদিবাসী মানুষেরা। ‘অরণ্যের অধিকার আইন, ২০০৬’ অনুযায়ী আদিবাসী ও বনবাসীরা ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগতভাবে বনভূমি ও গৌণ বনজ সম্পদের মালিকানাও বহন করেন। রয়েছে গ্রামসভার উপস্থিতি। ২০০৬ সালেই আদানি গোষ্ঠীকে কয়লা তোলার বরাত দিতে চেয়েছিল কেন্দ্রীয় সরকার। তাকে ঠেকিয়ে রেখেছিল গ্রামসভা। কিন্তু, সরকার বদলের সঙ্গে সঙ্গেই এই অরণ্যভূমিকে কয়লা খনির জন্য তুলে দেওয়া হয়েছে মাইনিং কোম্পানির হাতে।
হাসদেও আরন্ড বনাঞ্চল ছত্তিসগড়ের প্রায় ১৮০,০০০ হেক্টর এলাকা নিয়ে অবস্থান করছে। এই অঞ্চলে ৮০টির বেশি উদ্ভিদের প্রজাতি, স্তন্যপায়ী প্রাণী, মাছ, সরীসৃপ এবং পাখি প্রজাতির বৈচিত্র্য দেখা যায়। মধ্য ভারতের প্রায় ১৫০০ বর্গ কিলোমিটার বিস্তৃত অবিচ্ছিন্ন বনাঞ্চলের অংশ হাসদেও। কয়েকশ বছর ধরে এই অরণ্য আদিবাসীদের যেভাবে রক্ষা করেছে, ঠিক সেই ভাবেই আদিবাসীরাও এই অরণ্যকে রক্ষা করেছেন। কিন্তু ২০১৫ সালে কেন্দ্রীয় সরকার জানায়, “অরণ্যের অধিকার আইনের সাথে সাযুজ্যপূর্ণ কোনো অনুমতি ছাড়াও বিভিন্ন প্রকল্পকে নীতিগত ছাড়পত্র দেওয়া যেতে পারে।” ফলে কেবল হাসদেও নয় ভারতের সমস্ত আদিম ও জৈববৈচিত্র্য সমৃদ্ধ অরণ্য চলে যাচ্ছে কর্পোরেটদের দখলে। কেটে ফেলা হচ্ছে প্রাচীন গাছগুলি। অবধারিতভাবেই তার প্রভাব পড়ছে প্রকৃতির উপর।
হাসদেও আরন্ডের গ্রামবাসীরা কয়লা তোলার একটি প্রকল্পের কাজ এবং গাছ কাটার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছেন। নিজ ভূমি থেকে উৎখাত হওয়ার সমস্যা, ভৌমজলের সমস্যা, ভূমি ব্যবহারের সমস্যা, হাতি ও মানুষের ক্রমবর্ধমান সংঘাতের সমস্যা এবং সর্বোপরি বনবাসী-আদিবাসীদের সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য বজায় রাখার দাবি নিয়ে তাঁরা প্রতিবাদে করেছেন বিগত দশ বছর ধরে। কোন পরিবর্তন হয়নি, উলটে ২০২২ সালে মাইনিং কোম্পানি দ্বিতীয় দফার ধ্বংসের কাজও শুরু করে দিয়েছে। স্থানীয় মানুষ এখনও বিরুদ্ধ স্বর তুলে চলেছেন। মেইনস্ট্রীম মিডিয়া সেসব না দেখালেও, তাঁরা জোর গলাতেই বলে উঠছেন, “আমরা প্রাণ দেব, তবে এখানে কয়লাখনি হতে দেব না।’’
Discussion about this post