রবি ঠাকুরকে আমরা সাহিত্যিক, কবি এবং গীতিকার হিসেবেই এতদিন চিনে এসেছি। সাহিত্য কিংবা শিল্পে রবীন্দ্রনাথের ছোঁয়া লাগেনি, এমন কোনো দিক হয়ত নেই। তবে এককালে কবিগুরু যে বাংলা বিজ্ঞাপন জগতেও পা রেখেছিলেন, একথা হয়ত অনেকেরই অজানা। আজ্ঞে হ্যাঁ! অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি! বাংলা বিজ্ঞাপন জগতও তাঁর লেখনীর সৃজনশীলতার আলো পেয়েছিল। বিজ্ঞাপনের ভাষায় তিনি এক নতুন মাত্রা যোগ করেন। সহজভাবে বললে এখনকার দিনে শাহরুখ-বিরাটরা যা করছেন, সে যুগে রবীন্দ্রনাথও তাই করতেন। সেই সময়ের বিভিন্ন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান রবীন্দ্রনাথকে ব্যাপক হারে বিজ্ঞাপনে ব্যবহার করা শুরু করেছিল। তিনি ছিলেন বিরাট মাপের সেলিব্রিটি। তাই তাঁর ‘ফ্যান-ফলোয়ার’দের সংখ্যাও ছিল হিসেবের বাইরে। তাঁর সেই সেলিব্রিটি সত্ত্বাকে কাজে লাগিয়েই, বিজ্ঞাপনের জগতে জনপ্রিয়তা টানতে তাঁর সাহায্যপ্রার্থী হয়েছিল বহু ব্যাবসায়িক সংস্থাই।
তৎকালীন ৯০ টিরও বেশি পণ্যের বিজ্ঞাপনে এন্ডোর্সার হিসেবে যুক্ত হয়েছিলো কবিগুরুর নাম। কালি-কলম থেকে শুরু করে মাথার তেল, ক্রিম, সাবান, মেশিনারি, রেকর্ড এমনকি মিষ্টির প্রতিষ্ঠানগুলিও কবিগুরুকে তাদের বিজ্ঞাপনে ব্যবহার করেছিল। বিশ্বকবির কবিতা, গল্প বা রচনা দিয়ে সাজানো বিভিন্ন বিজ্ঞাপন পণ্যের এক আলাদা মর্যাদাই এনে দিত। সাবানের বিজ্ঞাপনে আমরা এতদিন নারীদের দেখেই অভ্যস্ত। কিন্তু ‘গোদরেজ’ সাবান ব্যবহার করল কবির ছবি। সঙ্গে কবির লেখা বিজ্ঞাপনের লাইন- “গোদরেজের চেয়ে ভালো কোনো বিদেশি সাবানের কথা আমার জানা নাই। তাই আমি সবাইকে এটা ব্যবহার করতে বলবো।” ব্যাস! সাবানের ব্যবসা বাড়তে আর বেশি সময় লাগল না। হাল-আমলের বর্ন ভিটার বিজ্ঞাপনেও ছিল তাঁর উজ্জ্বল উপস্থিতি।
তখন কালির পেনে লেখার রমরমা ছিল। তাই কালির চাহিদাও ছিল বেশ। লেখার জন্য বাজারে পাওয়া যেত ‘সুলেখা কালি’। সেই কালির বিজ্ঞাপনে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন- “সুলেখা কালি। এই কালি কলঙ্কের চেয়েও কালো।” ছোট অথচ যথাযথ ট্যাগলাইন। তার সঙ্গে চমৎকার উপমার প্রয়োগ। একদিকে ক্ষুরধার লেখনী আর অন্যদিকে কবিগুরুর এন্ডোর্সমেন্ট। এই দুইয়ে মিলে বাজারে তখন ‘সুলেখা’ কালির দারুণ ব্যবসা করেছিল। এই বিজ্ঞাপনের পাশাপাশি ‘শ্রীঘৃত ঘি’ নিয়েও তিনি এক চমৎকার বিজ্ঞাপনে লেখেন “বাংলাদেশে ঘৃতের বিকারের সঙ্গে সঙ্গে যকৃতের বিকার দুর্নিবার হয়ে উঠেছে। শ্রীঘৃত এই দুঃখ দূর করে দিয়ে বাঙালিকে জীবন ধারণে সহায়তা করুক” – এই কামনা করি।” ‘কুন্তলীন’ নামক এক চুলের তেলের বিজ্ঞাপনে ‘নারীর রূপ লাবণ্য’ নিয়ে কবি বলেন- “নারীর রূপ লাবণ্যে স্বর্গের ছবি ফুটিয়া ওঠে।” এছাড়াও লিপটন চা, রেডিয়াম ক্রিম সবেরই বিজ্ঞাপনে প্রধান মুখ ছিলেন কবি। এছাড়াও ‘জলযোগ মিষ্টি’র বিজ্ঞাপনে তিনি লেখেন, “জলযোগের মিষ্টান্ন পরীক্ষা করিয়া দেখিলাম। তৃপ্তি লাভ করিয়াছি। ইহার বিশেষত্ব আছে, সে জন্য ইহা আদরণীয়। এই সঙ্গে যে ‘দধি সেবন’ করিলাম তাহা বিশেষ প্রশংসার যোগ্য।” জলযোগ সে যুগে কেকের জন্য বিখ্যাত হলেও রবীন্দ্রনাথের সার্টিফিকেটের সুবাদে মিষ্টান্ন জগতেও প্রতিষ্ঠিত হবার সুযোগ পেয়েছিল।
তবে শুধু বেসরকারি কোম্পানিই নয়, সরকারি প্রতিষ্ঠানও বিজ্ঞাপনের স্লোগানের জন্য রবীন্দ্রনাথের সাহায্য নিয়েছিলেন। ভারতীয় রেলের বিজ্ঞাপনে ব্যবহৃত হয়েছে কবিগুরুর রোমান্টিক কবিতার দুটি লাইন, “রেলগাড়ির কামরায় হঠাৎ দেখা, ভাবিনি সম্ভব হবে কোনদিন।”এর সঙ্গে ছিল দু’দিকে দুই যুবক-যুবতীর চোরা চাহনি আর নিচে পূর্ব রেলের লোগো। সে যুগের সাদাকালো এই বিজ্ঞাপন রোমান্টিক বাঙালির রেলভ্রমণকে নিঃসন্দেহে রোমাঞ্চিত করেছিল বলাই চলে। শুধু নিজের দেশেই নয়, বিদেশের রয়্যাল ডাচ এয়ারলাইন্সের বিজ্ঞাপনের ক্ষেত্রে বিশ্বকবির শরণাপন্ন হয়েছিল।
বিভিন্ন নথি ও তৎকালীন সংবাদপত্র ঘেঁটে জানা যায়, ১৮৮৯ থেকে ১৯৪১ সাল পর্যন্ত ছোট-বড়, পরিচিত-অপরিচিত বিভিন্ন পণ্যের বিজ্ঞাপনেই রবীন্দ্রনাথ অংশ নিয়েছিলেন। কখনও মডেল, কখনও তাঁর লেখা এক-দুই লাইন বা কখনও বা প্রশংসা বাক্য! সবই শোভা পেয়েছে নানা বিচিত্র বিজ্ঞাপনে। কবিগুরুর গ্রহণযোগ্যতা ছিল সমাজের সব শ্রেণীতেই, এটা আজকের ‘সেলিব্রেটি’ জগতেও কিন্তু বিরল। এই কারণেই সেই সময় অসংখ্য বিজ্ঞাপনে তিনি অচিরেই যুক্ত হয়ে গেছিলেন। ভারতের এক অন্যতম দৈনিক সংবাদ পত্রকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ‘ইন্ডিয়ান অ্যাড ম্যান’ প্রহ্লাদ কক্কর বলেছেন, “এখনকার দিনে ব্র্যান্ড অ্যাম্বাস্যাডার বাছাই করা হয় মানুষের কাছে কার কতটা গ্রহণযোগ্যতা তার বিচারে। আর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো এলিট থেকে লেইম্যান পর্যন্ত সবার কাছে ঢালাও ভাবে গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি আর দু’টো নেই।” তাই বিজ্ঞাপনের জগতে রবীন্দ্রনাথই প্রথম রাস্তা দেখিয়েছিলেন, একথা স্বীকার না করে আর উপায় কী!
Discussion about this post