শহর কলকাতার ঠিক পাশেই পড়শি জেলা হিসেবে পরিচিত যে জেলা, তার নাম হাওড়া। এই জেলার আনাচে কানাচে লুকিয়ে রয়েছে সুপ্রাচীন এবং ঐতিহ্যবাহী বিভিন্ন ইতিহাস। এমনকি এমন অনেক কিছুই রয়েছে যা হয়ত বেশ প্রাচীন কিন্তু আজও বেশিরভাগ লোকচক্ষুর অন্তরালেই। ঠিক যেমন হিন্দু ও মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের সম্প্রীতির বাহক ভাই খাঁ পীরের মেলা। হাওড়া জেলার উদয়নারায়ণপুরের অন্তর্গত সিংটী গ্রামের বহু পুরনো এবং ঐতিহ্যবাহী এই মেলার বয়স কারোর মতে ৫০০ বছর, আবার কারোর মতে প্রায় ৭০০ বছর। প্রতি বছর পয়লা মাঘ সিংটী গ্ৰামের খাঁ পাড়ায় বিরাট এক মাঠ জুড়ে অনুষ্ঠিত হয় এই মেলা।
এই মেলার মূল আকর্ষণ হল আলুর দম এবং সামুদ্রিক কাঁকড়া। তাই অনেকের কাছে এই মেলা আলুর দম ও কাঁকড়ার মেলা নামেও পরিচিত। ছোট আকৃতির থেকে শুরু করে তিনশো বা চারশো গ্রাম ওজনের কাঁকড়ার পসরা সাজিয়ে বসেন বিক্রেতারা। তারা আসেন দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে। মেলার একটা দিকে শুধুই এই কাঁকড়া বিক্রি চলে। আর একটা বড় অংশ জুড়ে ওজনে বিক্রি হয় আলুর দম। প্রতি কেজি ৩০-৪০ টাকা। এই অঞ্চলে আলু প্রসিদ্ধ হবার কারণেই এই আয়োজন। এছাড়া মেলায় যেসব বিকিকিনি চলে সেগুলো তো রয়েইছে! স্থানীয় মানুষের কথা অনুযায়ী, এটি আদতে পীর সাহেবের মেলা হলেও এলাকাটি হিন্দু অধ্যুষত। তবে হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে সকলেই মেতে ওঠেন মেলার আমেজ নিতে। তাই বলা যায়, এই মেলার মাধ্যমেই সম্প্রীতির বার্তা ছড়িয়ে পড়ে সমাজের মধ্যে।
এত প্রাচীন এই ঐতিহ্যবাহী মেলা মানেই একজন বিখ্যাত ঐতিহাসিক চরিত্র থাকতে বাধ্য। এখানেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। জানা যায়, সুদূর আরব থেকে এখানে এসেছিলেন ভাই খাঁ নামক এক পীর। এখানে থাকাকালীন নিজের বিভিন্ন কীর্তিকলাপের জন্য ধীরে ধীরে তিনি অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। আসল নাম জানা না গেলেও তাঁর খেলার সঙ্গীরা সবাই তাঁকে ভাই খাঁ নামেই ডাকতেন। পৌষ মাসের ৩০ তারিখে তিনি দেহত্যাগ করেন। পয়লা মাঘ তাঁকে সমাধিস্থ করা হয়। সেদিন নাকি লক্ষাধিক মানুষ এসেছিলেন তাঁর শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে। অত মানুষ আসায় সেখানে নাকি একটা মেলা বসে গিয়েছিল। তখন থেকেই প্রত্যেক বছর এই ভাই খাঁ পীরের সমাধি দিবসে তাঁর নামেই এই মেলা বসে।
এই মেলার আয়ু কেবল একদিনই। সকাল থেকেই লোকসমাগম ঘটতে শুরু করে। দুপুরের পর থেকে তা পরিণত হয় লক্ষাধিক জনস্রোতে। ক্রেতা, বিক্রেতা, ভক্ত ও দর্শকের ভিড়ে জমজমাট হয়ে ওঠে মেলা। মেলা মানেই সম্প্রীতির পবিত্র অঙ্গন। তাই এখনও প্রতি বছর এই দিনে ভাই খাঁর স্মৃতি স্মরণ করে হিন্দু মুসলিম নির্বিশেষে সকলেই ভিড় জমান ঐতিহ্যবাহী এই মেলায়।
তথ্য এবং চিত্র ঋণ – পৃথ্বীশরাজ কুন্তী
Discussion about this post