দেশটির নাম মনে পড়লেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে দিগন্ত জুড়ে ধূ ধূ মরুভূমি। আর সেই মরুভূমির বুকের ওপর দাঁড়িয়ে ইতিহাসে মোড়া সারি সারি পিরামিড। পিরামিডের ভেতর রাখা কয়েক হাজার বছর ধরে সজ্জিত ফারাওদের মমি। বর্তমানে মিশর তার প্রাচীন ইতিহাস এবং সভ্যতার কারণে পৃথিবীর বুকে নিজের এক অন্য জায়গা ধরে রেখেছে। প্রায় প্রত্যেক বছরই পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বহু পর্যটক আসেন মিশরের এই প্রাচীন ইতিহাস ঘেঁটে দেখার জন্য। শুধু পিরামিডই নয়, মিশরের প্রাচীন প্রত্নতত্ত্বের মধ্যেও বিভিন্ন ধরনের মূর্তির দেখা মেলে। এর মধ্যে বিভিন্ন রাজা বা ফারাওদের মূর্তি থেকে শুরু করে দেব-দেবী এমনকি বিভিন্ন পশুপাখির মূর্তিও রয়েছে। মিশরীয়রা বিভিন্ন পশু-পাখিকে দেব দেবী হিসেবে পুজো করতেন।
তবে একটু খেয়াল করলে দেখা যাবে, মিশরে আজ পর্যন্ত যে সব মূর্তি খুঁজে পাওয়া গেছে তাদের মধ্যে একটি রহস্যময় মিল পাওয়া যায়। মূর্তিগুলোর বেশিরভাগেরই নাক ভাঙ্গা।এখানে একটা প্রশ্ন মনের কোণে ঘুরপাক খায়। একজন শিল্পী বহু কষ্টে মূর্তি তৈরি করলেন, সেটির নাকটি কেনই বা ভাঙা থাকবে! অনেকে মনে করেন এই মূর্তিগুলো যখন আবিষ্কৃত হয়েছিল, তখনই কোনও ঠোক্কর লেগে মূর্তিগুলোর নাক ভেঙে গিয়েছিল। কিন্তু সেক্ষেত্রে গুটি কয়েক মূর্তির ক্ষেত্রেই তা ঘটতে পারে। কিন্তু যখন প্রায় সব মূর্তিগুলিরই একই অবস্থা, তখন মনে প্রশ্ন জাগতে বাধ্য! এমনকি বিশ্বের যে জাদুঘরগুলোয় মিশরের প্রাচীন কিছু মূর্তি রয়েছে, সেখানকার কর্মকর্তাদের প্রায়ই এই প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়। তবে এই নাক ভাঙ্গার পেছনে প্রত্নতাত্ত্বিকরা বেশ কিছু কারণ বের করেছেন।
শুনতে অদ্ভুত মনে হলেও প্রাচীন মিশরীয়রা বিশ্বাস করতেন যে মূর্তির মধ্যেও প্রাণ রয়েছে। সেই প্রাণ যদি কখনও খারাপ ভাবে ফিরে আসে তাহলে তাদের সমূহ বিপদ। এই বিশ্বাসের ফলে মিশরীয়রা সিদ্ধান্ত নেন যে সমস্ত মূর্তিকেই হত্যা করতে হবে। মিশরীয়দের ধারণা ছিল যে মূর্তির মধ্যে যে প্রাণ রয়েছে সেটা তারা পায় নাক দিয়ে নেওয়া নিঃশ্বাস প্রশ্বাসের মাধ্যমে। ঠিক সেই কারণেই হত্যা করার একটি সহজ উপায় তারা খুঁজে বের করেন। সেটি হল মূর্তিগুলোর নাক ভেঙে ফেলা। মিশরে সাধারণত বিভিন্ন রাজা, রাণী বা ধনী ব্যক্তিদের মূর্তি তৈরি করা হত। যখন তারা বেঁচে থাকতেন তখন সেসব মূর্তির কোন ক্ষতি করা হত না। কিন্তু তাদের মৃত্যুর পরে মূর্তিগুলোর নাক ভেঙে সেগুলিকে ‘হত্যা’ করা হত। তাদের এই ভ্রান্ত ধারণাটি সারা মিশর জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। তবে সব সময় যে মূর্তিগুলোর নাক ভেঙে তাদের নষ্ট করা হত তা নয়, পাশাপাশি মুখের অন্যান্য অংশ বা হাত-পাও ভেঙে ফেলা হত।
তবে এই নাক ভাঙ্গার পেছনে যে শুধুমাত্র ভ্রান্ত ধারণা ছিল তা কিন্তু নয়। এর পেছনে কিছু ধর্মীয় কারণও ছিল। মিশরে খ্রিস্ট ধর্মের প্রচলন শুরু হওয়ার আগে থেকেই তারা বিভিন্ন দেব দেবীর মূর্তি বানিয়ে তাদের পূজা করতেন। খ্রিস্টীয় সপ্তম শতকের দিকে মিশরে পুরোপুরি ইসলাম ধর্মের প্রচলন ঘটে। ইসলাম ধর্মে মূর্তি পুজোর নির্দেশ নেই। তাই মিশরীয়রা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করার পর বুঝতে পারেন যে, মূর্তিগুলির মধ্যে কোন প্রকার প্রাণ শক্তি নেই। তখন তারা সেগুলিকে বিভিন্ন আকারে কেটে বাড়ি-ঘর তৈরির কাজে ব্যবহার করতে শুরু করেন। তবে বিভিন্ন গবেষক নাক ভাঙার পেছনে মূর্তিতে প্রাণ থাকার যে ধারণা ভ্রান্ত ধারণাটিকে যুক্তিযুক্ত বলেই মনে করেন। কারণ ধর্মীয় কারণে মূর্তিগুলো ভেঙে ফেলা হলে তা একেবারে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। কিন্তু আজও মিশরের বিভিন্ন জায়গা খুঁজলে ভাঙা মূর্তির দেখা মেলে। তবে এই মূর্তি ভাঙার পেছনে সঠিক কারণ ঠিক কী, তা এখনো বের করা সম্ভব হয়নি। গবেষকরা বিষয়টি নিয়ে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন। ফলে নতুন অনেক তথ্যই উঠে আসছে। আসলে প্রাচীন মিশরের ইতিহাস এতটাই রহস্যময় যে উপযুক্ত প্রমাণ ছাড়া কিছুই বের করা হয়ত সম্ভব নয়। তাই যতদিন না সঠিক তথ্য মিলছে, ততদিন এই রহস্যময় বিষয়গুলি হয়তো আমাদের অজানাই থেকে যাবে।
Discussion about this post