স্বাস্থ্যের দিক দিয়ে একের পর এক ভয়। মৃত্যুর দুশ্চিন্তা নিয়েই কি কাটাতে হবে বাকি দশকটা?
এ রকম ঘটনার সাক্ষী মানুষ সভ্যতার জন্মলগ্ন থেকেই ছিল। আদিম প্রস্তর যুগে বন্য পশুদের আক্রমণকে ভয় পেত মানুষ। আজকে সেই জায়গাটা দখল করেছে বিভিন্ন ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া কিংবা পরজীবী। কালের নিয়মে অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে মানুষ বুঝে গিয়েছে কীভাবে এই ধরণের আক্রমণ থেকে আত্মরক্ষা করতে হয়। এর আগে বহু মহামারী হয়েছে। বহু লোকক্ষয়ও হয়েছে। কিন্তু সভ্যতা ধ্বংস হয়ে যায়নি। গুটি বসন্ত এবং স্প্যানিশ ফ্লুয়ের মহামারীতে প্রচুর মানুষ মরেছেন। কিন্তু এখন এসব রোগে সেরকম কেউ মারা যান না। একইভাবে আগামীতে করোনাকেও মানুষ জয় করে ফেলবে।
কীভাবে এলেন চিকিৎসার পৃথিবীতে? অনুপ্রেরণা কে ছিলেন?
আমার ছোটবেলায় দেখতাম মা খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। সেই সময়ে তাঁকে হাসপাতালেও ভর্তি করতে হয়। যমে-মানুষে লড়াই করে মা সুস্থ হয়ে ফেরেন। যে ডাক্তার এবং স্বাস্থ্যকর্মীরা মা’কে সুস্থ করে তোলেন তাঁদের দেখে আমার মনে উৎসাহ জাগে। ভাবতে শুরু করি, আমিও যদি ডাক্তার হয়ে ভবিষ্যতে শুধু মা নয়, বরং অনেক মানুষকে সুস্থ করে তুলতে পারি। মা আমাকে ডাক্তারির ব্যাপারে উৎসাহ জুগিয়ে গিয়েছেন।
তিন দশক ধরে আপনি এই পেশার সঙ্গে যুক্ত। ৩০ বছর আগের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা এবং হাল আমলের পরিস্থিতি। কতোটা বদলেছে ছবিটা?
ডাক্তারি পাশ করার পর আমি কিছুদিন প্রাইভেট প্র্যাকটিস করেছিলাম বেহালার সরশুনায়। তখনকার সঙ্গে এখনের প্রাইভেট প্র্যাকটিসে বেশ বড়সড় পরিবর্তন এসেছে। আমরা ৩০ বছর আগে মামুলি কিছু ওষুধই দিতে পারতাম। জোর দিতাম “প্রিভেনশন ইজ বেটার দ্যান কিওর” আপ্ত বাক্যটিতে। তবে বর্তমানে মেডিকেল সায়েন্সে ব্যাপক উন্নতির ফলে যে কোন রোগ আমরা চট করে ধরে ফেলতে পারছি। তাঁর উপযুক্ত চিকিৎসা পরিষেবাও দিতে পারছি। আগে জ্বরের যে কারণগুলি ছিল, বর্তমানে তা অনেকটাই বদলে গিয়েছে। আগে জ্বর হলে একটা বড়ি কিংবা মিক্সচার দিয়ে দেওয়া হত। কিন্তু এখন প্রযুক্তির উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে ব্যাকটেরিয়া কিংবা ভাইরাসও চরিত্র বদলে মিউটেটেড হয়েছে। কাজেই আগের মতো স্বাভাবিক প্রতিরোধ ক্ষমতায় আমরা সুস্থ হতে পারছি না।
অনেক মানুষকে যেমন সুস্থ করে তুলেছেন, তেমনিই অনেককে সুস্থ করতে পারেন নি। অকালে ঝড়েছে অনেক প্রাণ। সেটাকে কী নামে ডাকবেন? পরাজয় নাকি ব্যর্থতা?
স্যারেদের অধীনে যখন ট্রেনিংয়ে যখন ছিলাম, তখনও দেখেছি বেশ কিছু রোগী আপ্রাণ চেষ্টার পরেও মারা গিয়েছেন। তাঁদের শারীরিক জটিলতার যথাসাধ্য চিকিৎসার পরেও তাঁরা বাঁচেন নি। একইভাবে প্রাইভেট প্র্যাকটিসের সময়ও আমার খেয়াল থাকে চিকিৎসায় যেন বিন্দুমাত্র ত্রুটি না থাকে। তার পরেও অজ্ঞতা বশতঃ কিছু ত্রুটি থেকে গিয়েছে যার ফলে রোগীর অবস্থার অবনতি হয়েছে। কিন্তু আমার জ্ঞানত আমি যখনই জেনেছি রোগীর উন্নতি হচ্ছে না, আমি সঙ্গে সঙ্গে ‘সেকেন্ড ওপিনিয়ন’ নিয়েছি। সেই সঙ্গে ভালো হাসপাতাল বা ডাক্তারের কাছে রেফার করে দিয়েছি। তার মধ্যেও যে সামান্য কিছু ভুল ঘটনা ঘটেছে তার থেকে আমি শিক্ষা নিয়েছি যাতে আগামীতে নির্ভুল পরিষেবা দিতে পারি।
জীবনের একটি ভালো এবং একটি খারাপ অভিজ্ঞতার কথা শেয়ার করুন ডেইলি নিউজ রিলের দর্শকদের সঙ্গে।
২০১৭ সালে চিকিৎসা সংক্রান্ত একটি প্রোজেক্ট আমরা তিন চিকিৎসক বন্ধু পেশ করি। গ্লোবাল হেলথ অর্গানাইজেশন ডার্মাটোলজির ক্ষেত্রে সেই প্রোজেক্ট আহ্বান করেছিলেন। আর্সেনিক জনিত জলদূষণের ফলে হওয়া চামড়ার ক্ষতি নিয়ে আমাদের কাজ জমা করি। বিশ্বের নানা দেশের ১৩২ টি প্রোজেক্টের মধ্যে সেটি ২০১৮ সালে বিশ্বে প্রথম স্থান অর্জন করে। আমরা ৪৬০০০ ডাক্তারের সামনে কেরলে সম্মানিত হই।
খারাপ অভিজ্ঞতাও যদিও অন্যরকম ভাবে এই প্রোজেক্টকে ঘিরেই। ২০০১ সালে উক্ত প্রোজেক্ট নিয়েই আলোচনা সভা করতে আমরা গিয়েছিলাম বড়াই গ্রামের পাঠাগারে। সেদিন ছিল সম্ভবতঃ মরসুমের শীতলতম দিন। আমাদের ড্রাইভার ঘটনাচক্রে প্রচুর মদ্যপান করে। ফেরার সময় রাতে আমরা দুর্ঘটনার কবলে পড়ি। আমাদের গাড়ি বেসামাল হয়ে রোডে ওঠার আগেই কনকনে ঠাণ্ডা জলে পড়ে যায়। গাড়ি ডুবতে দেখে আমি কোনরকমে গাড়ির দরজা খুলে বেরিয়ে আসি। ধীরে ধীরে সবাইকে উদ্ধার করা হয়। এদিনটি আমার পক্ষে ভোলা মুশকিল।
জীবনের সাফল্যের খাতায় কোন কোন ঘটনাকে রাখবেন?
এ বছরেই ইন্ডিয়ান মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের হেড কোয়ার্টার থেকে প্রফেসর উপাধি পেয়েছি। ‘ফোর্বস’ ম্যাগাজিনে আমার সাক্ষাৎকার অতি সম্প্রতি প্রকাশ পেয়েছে। তবে একটি ঘটনার কথা বলতে খুব ইচ্ছে করছে আজ। আমি তখন নীলরতন সরকার হাসপাতালে হাউজ স্টাফ। সেই সময় এক ভদ্রলোক অচেতন অবস্থায় ভর্তি হন। তাঁর তিন মেয়ে ব্যাকুলভাবে বাবার সুস্থতা প্রার্থনা করছিলেন। আমাদের স্যারের নির্দেশে দু’দিন ধরে যাবতীয় পরীক্ষা নিরীক্ষার পরেও ওনার জ্ঞান ফেরেনি। আমার হঠাৎ মনে হল এটি নার্ভের সমস্যা থেকে হতে পারে। আমি নিউরোলজি বিভাগের আরএমও’র সঙ্গে কথা বলি। তিনি জানালেন, মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হয়েছে এবং এটি স্নায়ু সংক্রান্ত গভীর সমস্যা যার দ্রুত অপারেশন দরকার। আমাদের স্যারের অনুপস্থিতিতেই সিদ্ধান্ত নিয়ে বাড়ির লোককে কনসেন্ট ফর্মে সই করিয়ে অপারেশনের ব্যবস্থা করি। আশ্চর্যের বিষয়, অপারেশন সফল হতেই ভদ্রলোকের জ্ঞান ফেরে। তাঁর অসহায় মেয়ের মুখে স্বস্তির হাসি খুব আনন্দ দিয়েছিল। তবে দুঃখের বিষয় আমাদের স্যার পরের দিন বিষয়টি জেনে আমাকে খুবই তিরস্কার করেন।
আপনার সাহিত্য রসে ডুবেছেন বহু মানুষ। এই বিষয়ে আপনি কী বলবেন?
পেশা আমার ডাক্তারি। অর্থাৎ রোগীর সেবা করাটাই আমার ধর্ম। এবার এই ডাক্তারি জীবনের একঘেয়েমি কাটাতে লেখালেখি করি। তবে এই অভ্যেস আমার ছোটবেলা থেকেই। বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় লেখার পাশাপাশি সমরেশ বসুর ‘মহানগর’ পত্রিকাতেও লিখেছি। এটা যে সাহিত্য চর্চা করছি বলে করতে হবে এরকম নয়। এটা আনন্দ, নেশা আমার কাছে। অল ইন্ডিয়া রেডিও সহ বিভিন্ন জায়গায় আমার লেখা পড়া হয়। লেখাগুলি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে আর্কাইভ করে রাখার উদ্দেশ্যে প্রথম বই বের করি ‘ছন্দে প্রদীপ দ্যুতি’। তারপর বেশ কিছু গল্প সংকলিত করে ‘বইয়ের নাম দিলাম ‘গল্প ভাবনা’। ডাক্তারির লেখালেখি নিয়ে প্রকাশ পায় ‘স্বাস্থ্যে ভাবনা’ এবং ‘রোগ নিয়ে ভাবনা’ এবং ‘রোগভোগের সাতকাহন’। গত বছর অণু গল্প সংকলন হিসেবে প্রকাশ পায় ‘গল্পাণু’। আগামী বইমেলাতে আমার লেখা পত্র নিয়েই একটি বই দে’জ পাবলিশার্স থেকে বের হচ্ছে ‘চিঠি শুধুই স্মৃতি’। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের যদি আমার লেখা আগামীতে ভালো লাগে, তাহ্লে এই লিখে যাওয়াটা সার্থক মনে হবে।
এই মুহূর্তে প্রাইভেট প্র্যাকটিসের মাধ্যমে চিকিৎসা করা ছাড়াও আর কী কী দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছেন?
আমি একাধিক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত। বিশেষ করে ইন্ডিয়ান মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের শ্রীরামপুর শাখার আমি সভাপতি। এখানে সপ্তাহে দু’দিন বাচ্চাদের অনাক্রম্যতা টিকা বা ইমিউনাইজেশন ভ্যাক্সিন দেওয়া হয়ে থাকে। গত দেড় বছরে গোটা বিশ্ব জুড়ে চলা সেই খারাপ পরিস্থিতিতেও চালু ছিল আমাদের এই পরিষেবা। এছাড়াও বয়স্কদের জন্য বরেণ্য বার্ধক্য পরিষেবা যেখানে মাসে একবার করে চেক-আপ এবং বছরে ২ বার ঘুরতে নিয়ে যাওয়া হয়। রয়েছে শনি-রবিবার বাচ্চাদের টেবিল টেনিস প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা। স্বাস্থ্য ভাবনা ওয়েলফেয়ার সোসাইটির আমি সম্পাদক। ২২ বছর ধরে আর্সেনিক নিয়ে কাজের পাশাপাশি বৃষ্টির জল ধরে রেখে চাষের কাজে লাগানো নিয়েও কাজ চলছে। সেন্ট্রাল ডান্স অ্যাকাডেমি অফ শ্রীরামপুর সহ আরও বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছি।
হবু ডাক্তারদের কী পরামর্শ দেবেন?
একটাই বার্তা। ডাক্তারি পাশ করেই তাঁরা যেন এই ইন্ডিয়ান মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের সাথে যুক্ত হয়ে বিভিন্ন সমাজসেবামূলক কাজ করেন। মনে রাখতে হবে ডাক্তারি পড়ার পিছনে সেই ছাত্রের নিজের অথবা বাড়ির লোকের যেরকম খরচ হয়েছে, ঠিক তেমনিই জনসাধারণের অবদানও রয়েছে যথেষ্টই। কাজেই তাঁদের উচিৎ নিজের প্রয়োজনীয় রোজগারটুকু করে মানুষকে কিছু ফিরিয়ে দেওয়া।
দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থায় কোন কোন ক্ষেত্রে আপনি দিনবদলের স্বপ্ন দেখেন?
এই মুহূর্তে কিউরেটিভ পর্যায়ে আমাদের দেশ রয়েছে। অর্থাৎ রোগ দেখব এবং রোগের চিকিৎসা করব। কিন্তু বিদেশে ইউরোপের ১১ টি দেশে ভ্রমণকালে খেয়াল করলাম, তাঁরা রোগ হওয়ার থেকে না হওয়ার দিকেই বেশি যত্ন নেন। অর্থাৎ যে পরিবেশে রোগ হতে পারে, সেই পরিবেশ কোনভাবেই তাঁরা খারাপ হতে দেন না। ফলে মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায় না। যার ফলে রোগ হলেও ভাইরাস-ব্যাকটেরিয়া বিশেষ সুবিধা করতে পারে না। অসুস্থতার পরিমাণ এমনিতেই কম হয়ে যায়। পরিবেশকে সুন্দর রাখার দায়িত্ব প্রশাসন থেকে সাধারণ মানুষ প্রত্যেকে নিয়ে নেয়, তাহলে সুস্থতার দিকে অনেকগুলো ধাপ আমরা এগিয়ে যাব আমরা।
শরীরের মন খারাপ নাকি মনের শরীর খারাপ? কোনটা বেশি ভয়ানক আপনার মতে?
আমাদের অসুখ-বিসুখের মধ্যে দেখা গিয়েছে ৮৫% হয় মনের কারণে। বাকি ১৫% সংক্রামক রোগের জন্য। এখন সংক্রামক রোগের জন্য রয়েছে প্রতিষেধক। তাই মন ভালো রাখলে খুব স্বাভাবিকভাবেই শরীর সুস্থ থাকবে। মন ভালো রাখার জন্য পরিশ্রম, পরিমিত আহার, ধ্যান এবং ভালো কাজ করে যাওয়া জরুরি।
স্টেথোস্কোপ, সাদা অ্যাপ্রন, চেম্বার, ফিজ এসবের বাইরেও যদি ডাক্তারির সংজ্ঞা যদি কিছু থেকে থাকে তাহলে সেটা কী?
ডাক্তারকে আমরা কীভাবে চিনি? ডাক্তারের গায়ে একটা সাদা অ্যাপ্রন থাকবে, গলায় ঝুলবে স্টেথোস্কোপ। সেই সঙ্গে গুরুগম্ভীর ভাব, কম কথা বলবেন। আমি বলবো সেটা কিন্তু ঠিক না। ডাক্তার মানুষের সঙ্গে মাতবে। কারণ মানুষের জন্যই সে উঠে এসেছে। যে ডাক্তার যত বেশি মানুষের সঙ্গে কথা আদান প্রদান করেন, তিনি তত বেশি জনপ্রিয়। মানুষের অনেক কিছু জিজ্ঞাসা থাকে কিন্তু গম্ভীর ডাক্তারকে জিজ্ঞাসা করে উঠতে পারে না। তাহলে সেই ডাক্তার যতই ডিগ্রিধারী হন না কেন, রোগ সারানোর দিকে এগোতে পারবেন না। তাই বলবো, ডাক্তারির যে আবরণ তাঁর বাইরে এসে ডাক্তাররা একটু সামাজিক হোক, এক্তু মানবিক হোক।
Discussion about this post