গুরুতর অসুস্থ সন্তান। চিকিৎসার জন্য হন্যে হয়ে ডাক্তার খুঁজছেন মা। সারাদিন কেটে গেল, মায়ের হাজার অনুরোধেও সাড়া দিলেন না কেউ। মুখ ফিরিয়ে থাকলেন প্রতিবেশীরাও। অবশেষে সন্ধ্যায় বিনা চিকিৎসায় মারা গেল সন্তান! কিন্তু, এতটা অমানবিক হওয়াও কি সম্ভব? হয়তো সম্ভব। কারণ, সন্তান যে চারপেয়ে! গতকাল এমনই ঘটনার সাক্ষী হলেন হুগলীর শ্রীরামপুর নিবাসী শ্রাবণী চৌধুরী।
পেশায় সঙ্গীতশিল্পী শ্রাবণী চৌধুরী এককথায় ‘পশুপ্রেমী’। কলেজ-জীবন থেকে শুরু করে মাঝে পেরিয়ে গিয়েছে অনেকগুলো বছর, কিন্তু পশু-পাখিদের প্রতি তাঁর ভালোবাসা কমেনি এতটুকুও। বরং তাঁর দেখাদেখি তাঁর স্বামী ও কন্যাও নিজেদের নিয়োজিত করেছেন জীবসেবায়। প্রতিবেশীদের কটূক্তি উপেক্ষা করে বাড়ির পোষ্য থেকে পথকুকুর – সকলকেই সন্তানস্নেহে পালন করেন তিনি। তাদেরই মধ্যে ছিল বছর তিনেকের ‘অ্যালবিনো’। দিন তিনেক আগে ঝড়-জলের মধ্যেই শ্রাবণীদেবী লক্ষ্য করেন, হাঁটা চলা করতে পারছে না অ্যালবিনো। লেজের ক্ষতস্থান থেকে ঝরছে রক্ত, এমনকি উঠেও দাঁড়াতে পারছে না সে। কোনওক্রমে বাড়ির সামনে তাকে এনেই খবর দেন পরিচিত পশু চিকিৎসককে। বহুবছর ধরে বিনা পারিশ্রমিকে পথকুকুরদের সেবা করে আসছেন তিনিও। নিজে অসুস্থ থাকায় আসতে না পারলেও প্রাথমিক চিকিৎসার কিছু পদ্ধতি বাতলে দেন তিনি। সেগুলো দু’দিন ধরে অনুসরণ করে রক্তপাত বন্ধ হয়। কিন্তু ততক্ষণে ধরা পড়েছে সংক্রামক ভাইরাসঘটিত রোগও।
এরপর গতকাল মেয়ের সাহায্য নিয়ে তখন গুগল থেকে একটি এনজিওর নম্বর জোগাড় করেন তিনি। তাতে যোগাযোগ করলে আবার অন্য একটি নম্বর দেওয়া হয়। এইভাবে চলতে চলতে পাঁচবারের পর যাঁর সাথে কথা হয়, তারাও নানান অজুহাতে সাহায্য থেকে পিছিয়ে আসেন। এরপর আরেকটি এনজিও’র সঙ্গে যোগাযোগ করলে তাঁরা শ্রীরামপুরের এক চিকিৎসককে পাঠানোর আশ্বাস দেন। সকাল গড়িয়ে তখন প্রায় দুপুর, এদিকে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে অ্যালবিনো। অনেকক্ষণ অপেক্ষার পরেও কেউ এল না দেখে ওই চিকিৎসকের সঙ্গে ফের যোগাযোগ করেন তিনি। উত্তর পান, বৃষ্টি থামলে আসবেন। বিকেল নাগাদ বৃষ্টি থামলে যতক্ষণে তিনি আসেন, ততক্ষণে আর কিছুই করার ছিল না। অবশেষে সন্ধ্যায় সব যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পায় অ্যালবিনো।
‘ডেইলি নিউজ রিল’-কে ঘটনার কথা জানাতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন শ্রাবণীদেবী। সাথে ক্ষোভও উগরে দেন সকলের প্রতি। তিনি বলেন, “এতগুলো মানুষকে ফোন করলাম সকাল থেকে। কেউ একটিবার এল না সারাদিনে। আর একটু আগে চিকিৎসাটা শুরু হলে আমার বাচ্চাটা বেঁচে যেত।” প্রতিবেশীরাও কেউ এগিয়ে আসেননি একটিবারের জন্যেও। অনেক সংস্থাই তাদের কাজে মানবিকতার নিদর্শন রেখে চলেছে প্রতিনিয়ত। কিন্তু পাশাপাশি গতকালের এই ঘটনা স্বাভাবিকভাবেই তুলে দিয়েছে বেশ কিছু প্রশ্ন। মানুষের মানবিকতা কি তবে সত্যিই বিলুপ্তির পথে? নাকি সন্তান চারপেয়ে বলেই এতখানি অবজ্ঞা? সত্যিই কি আশেপাশের কেউ পারতেন না অ্যালবিনোকে বাঁচাতে? সঠিক উত্তর থেকে যাবে অধরাই।
Discussion about this post