রবি ঠাকুরকে নিয়ে যেন সবসময় একটা কৌতূহলের আসর বসে বিশ্ব জুড়ে। দেশি হোক কি বিদেশি তাঁর অনুরাগীর সংখ্যা তো অগুণতিই। কিন্তু স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ কার বা কাদের অনুরাগী ছিলেন তার খবর রেখেছেন কি? নিশ্চয়ই এমন কোনো মানুষের কথাই আপনার মাথায় আসবে যার খ্যাতির ভান্ডার রয়েছে জগৎ জোড়া, তাই না! কিন্তু তা একেবারেই নয় মশাই! রবিঠাকুর আসলে চিরকালই খুদেদের ভক্ত কিংবা অন্ধভক্ত বললেও হয়ত ভুল হবে না। যারা সময়ে অসময়ে হত্যে দিত কবিগুরুর দোরগোড়ায় নয়তো বা অবলীলায় বকবক করে যেত ওই প্রবাদপ্রতিম মানুষটির সঙ্গে, তাদেরকেই ভীষণভাবে ভালোবাসতেন তিনি। আজ তেমনই এক খুদের কথা বলব যাকে নিয়ে রবীন্দ্রনাথের চলত নিত্য ওঠাবসা।
জন্মের পর প্রথমবার মা রানী চন্দ ও বাবা অনিল চন্দের সঙ্গে শান্তিনিকেতনে এল এক কোলের শিশু। আর তাকে দেখা মাত্রই পরম স্নেহে কোলে তুলে নিলেন রবিঠাকুর। নাম রাখলেন ‘অভিজিৎ’। প্রথম যেদিন অভিজিৎ হামাগুড়ি থেকে দু’পায়ে ভর দিয়েছে কী ভীষণ খুশি সেদিন তিনি। আধো আধো করে যখন অভিজিৎ ‘দাদু’ বলে ডাক দিত কবি তখন আদর করে ‘যুবরাজ’ বলে আগলে ধরতেন। জ্ঞান হওয়ার আগে থেকেই বাচ্চাটি তার মায়ের কোলে চড়ে রোজ ওই একগাল ভর্তি সাদা দাড়ির বুড়োটাকে চিনেছে। তাই কবি যেদিন বাড়িতে থাকতেন না সে ছেলে তো কেঁদেকেটে একাকার। তারপর যখন থেকে চলতে শিখল, আর দাদুর কাছে যাওয়া থেকে আটকায় কে? রোজ সকালে দাদুর থেকে তিনটে লজেন্স তাকে নিতেই হবে। আর দাদুও তেমনি, ঘরে থাকুক বা না থাকুক আদরের যুবরাজের জন্য বয়াম ভর্তি লজেন্স সবসময়ই তৈরী। এক কথায় কবির ভীষনরকম নেওটা ছিল সেই অভিজিৎ। কখনও সোনাঝুরির পাতা তুলে আনছে তো কখনও দাদুর সাদা কাগজে আঁক চিরে কাটছে। কখনও শিমূল তলায় দৌড়ে বেড়াচ্ছে তো কখনও চাঁদ দেখছে দাদুর কোলে বসে। রবি ঠাকুরের সমস্তটা জুড়েই যেন ছিল ছোট্ট অভিজিতের দুষ্টুমি।
কবি তখন ভীষণ অসুস্থ একরকম শয্যাশায়ী। বাড়িময় উদ্বেগ দুশ্চিন্তায় দিন কাটাচ্ছেন পরিবারের লোকেরা। তার মধ্যেই চার বছরের অভিজিৎ এসে তার দাদুর গা ঘেঁষে জানালো কবির লেখা সব কবিতা তার মুখস্থ হয়েছে। সেবারের মতো অভিজিতের জন্যই হয়ত ওই অসুস্থ মানুষটা বাঁচার রসদ ফিরে পেয়েছিলেন। কিন্তু অভিজিতের চোখের সামনেই তার নিত্য খেলার সাথী দাদু যেন কেমন একটু করে সরতে থাকলেন। কখনও নিস্তেজ শরীরে পড়ে থাকতেন কখনও বা অভিজিতের গুটিগুটি পায়ে ঘরে ঢোকাটা চুপচাপ অনুভব করতেন। তারপর এল সেই বাইশে শ্রাবণ ঝরা শিউলির পথ বেয়ে কবির বিদায় পালা। সাদা কাপড়ে মোড়া ফুলে ভরা কবির নিথর দেহটা পড়ে রয়েছে। সবাই মিলে যেই কাঁধে তুলেছে কবিকে অমনি ভিড়ের মাঝে একটাই চিৎকার ভেসে এল “দাদুকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছো? দাদুর যে কষ্ট হবে।” অভিজিতের দাদু আর ফিরলেন না। ছোট অভিজিৎকে একলা করে চলে গেলেন চিরকালের মতো। না তারপর থেকে আর কোনোদিন লজেন্সের বয়াম খুঁজে ফেরেনি রবি ঠাকুরের আদরের যুবরাজ।
Discussion about this post