আক্ষরিক অর্থে দেখতে গেলে প্রাচীনকাল থেকেই পিতৃতান্ত্রিক সমাজে নারীরা অবহেলিত। প্রাচীনকাল থেকেই সমাজ-সংস্কৃতি নারীদের গন্ডিতে আবদ্ধ করে রেখেছে। এর পিছনে ছিল নানান কুসংস্কার, অপপ্রচার ও কুৎসা। শিক্ষার দুয়ারে নারীদের প্রবেশ ছিল নিষিদ্ধ। যদিও হাল আমলে এই অবস্থার উন্নতি ঘটেছে। নারীরা আজ শিক্ষার প্রসারে পুরুষদের থেকে কম কিছু নয়। ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে প্রাচীনকাল থেকে বর্তমান কালের নারীশিক্ষার প্রসারের এই যাত্রাপথ খুব একটা মসৃণ ছিল না। এসেছিল বহু বাধা, বিপত্তি, বিরোধ। কিছু মহাপুরুষের কৃতিত্ব এই যাত্রায় অপরিসীম। তেমনই একজন ছিলেন শ্রী কালীকৃষ্ণ মিত্র৷
এছিল ভারত স্বাধীন হওয়ার ১০০ বছর আগের ঘটনা। ভারতে তখন রমরমিয়ে চলছে ব্রিটিশরাজ। বাংলার বুকে তখন নারীরা অবহেলিত, পীড়িত, কুসংস্কারে আচ্ছন্ন। সেই সময় সমাজে নারীদের অবস্থান শ্রী কালীকৃষ্ণ মিত্রকে বিব্রত করেছিল। নারীশিক্ষা প্রসারের জন্য তিনি দাদা নবীনকৃষ্ণ মিত্র ও খ্যাতনামা শিক্ষক প্যারীচরণ সরকারের সহায়তায় বারাসাতের বুকে ১৮৪৭ সালে একটি মেয়েদের স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। এটি ছিল অবিভক্ত বাংলায় মিশনের নিয়ন্ত্রণের বাইরে ধর্মনিরপেক্ষ প্রথম মহিলা বিদ্যালয়। এটিই হল বারাসাতের জনপ্রিয় ‘বারাসাত কালীকৃষ্ণ উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়’। এই স্কুল প্রতিষ্ঠার জন্য শিক্ষা বিরোধী সমাজপতিদের বাধা বিপত্তি এমনকি সমাজচ্যুত পর্যন্ত হতে হয় প্রতিষ্ঠাতাকে। এই স্কুলটি শুরু হয়েছিল মাত্র দুইজন মহিলাকে নিয়ে। তার মধ্যে অন্যতম একজন ছিলেন নবীনকৃষ্ণ মিত্রের মেয়ে কুন্তিবালা। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয় এমনকি বেথুন সাহেবও কালিকৃষ্ণ মিত্রের কাজকে সমর্থন করেছিলেন।
বাংলায় নারীশিক্ষার প্রসারে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয়। তিনি উপলব্ধি করেন যে, নারীজাতির উন্নতি না হলে বাংলার সমাজ ও সংস্কৃতির উন্নতি কখনোই সম্ভব নয়। ১৮৪৭ সালে কালীকৃষ্ণ স্কুল প্রতিষ্ঠার পর শোনা যায় এই বিদ্যালয়ের প্রথম ছাত্রী, নবীনকৃষ্ণের মেয়ে কুন্তীবালাকে পড়াতে কলকাতা থেকে প্রায় ১৬ মাইল রাস্তা হেঁটে আসতেন স্বয়ং বিদ্যাসাগর মহাশয় । সেই ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আজও দাড়িয়ে আছে বারাসত কালীকৃষ্ণ উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়।
এরপর বহু যুগ কেটে গেছে কিন্তু এই স্কুলের ঐতিহ্য একইরকম ভাবে বর্তমান। সাদা জামা – সবুজ স্কার্ট, মাথায় সাদা ফিতে পরা ছোট ছোট মেয়েগুলো চোখে জল নিয়ে প্রথম পা দেয় স্কুলের উঠোনে আবার একইভাবে সাত বছর পর চোখে জল নিয়ে স্কুলটাকে শেষ বারের মত বিদায় জানায়। সকাল ১১টায় ঢং ঢং শব্দে সবুজ গেট খোলা থেকে শুরু করে প্রেয়ারের জনগণমন, বড় বড় ক্লাসরুম, দিদিমণিদের শাসন, একই বেঞ্চে টিফিন ভাগাভাগি, কত বন্ধুত্ব-ঝগড়া- বিচ্ছেদ, কত খারাপ থাকা – ভালো থাকা। ; ৫৯ এল, কেএনসি রোডের এই সাদা সবজে দালানগুলো কত ঘটনার সাক্ষী। মিস বা ম্যাম নয় এই স্কুলের দিদিমণিরা ‘দিদি’ তেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য। স্কুলের এক প্রাক্তনী রিয়া বিশ্বাসের কথায় “স্কুল জীবনের এই সাত বছরে, আমি অনেক শিক্ষিকার কাছ থেকে শিখেছি, তবে তাদের সকলের মধ্যে প্রেমময় প্রকৃতি এবং প্রভাবশালী ব্যক্তিত্বের ছাপ আমার হৃদয়ে আজও রয়েছে। আমি কীভাবে স্কুল জীবনের বন্ধুদেরকে ভুলে যেতে পারি যার সঙ্গে আমি বছরের পর বছর আনন্দ করেছি। আমার সমস্ত বন্ধু খুব উৎসাহী, দুষ্টু এবং পরিশ্রমী ছিল। তাদের বন্ধুত্ব আজও একই রয়েছে। স্কুল জীবনের শেষ দিনটিতে দেখতে হয়েছিল বিদায় অনুষ্ঠান! সেদিনও সহপাঠীদের ছেড়ে যাওয়ার সময় হৃদয় ছিঁড়ে যাচ্ছিল। ছাত্র জীবনের সেই মিষ্টি দিনগুলি স্বপ্নের মতো কেটে ছিল।“
আরেক প্রাক্তনী কৌশাম্বী দাসের কথায়, “ আমার বয়স যখন ১০ তখন থেকে আমি এই স্কুলে পড়ার সুযোগ পাই। এখন আমার বয়স ১৮, অনেকগুলো বছর আমি এই স্কুলে কাটিয়েছি তার অনেক মুহুর্ত এখনো মনে গেঁথে আছে। প্রথম দিনের সাদা-সবুজ স্কুল ড্রেসটা আজও যত্নে গুছিয়ে রেখেছি নিজের আলমারিতে। প্রথমদিন সকাল সাড়ে ১০ টায় মা’র হাত ধরে দাঁড়িয়ে ছিলাম ওই সবুজ গেটটা খোলার অপেক্ষায়। এক অজানা ভয় ছিল তখন। অনেক বন্ধু পেলাম এখানে এসে। সব থেকে অবাক লাগে ক্লাসরুমগুলোকে, ব্যাচের পর ব্যাচ আসে যায় আর ওই ঘরগুলো অবিকল একইরকমভাবে কত স্মৃতি বয়ে বেড়ায়। স্কুলের দিদিরা আমাদের মনুষ্যত্ব শিখিয়েছিল; শিখিয়েছিল মানুষ হতে; শিখিয়েছিল জীবনে যতই কঠিন পরিস্থিতি আসুক না কেন হার মানা চলবে না। শেষ পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যেতে হবে। এখন এই মুহুর্তগুলোকেই খুব মিস করি। আজও ওই সবুজ স্কার্ট আর সাদা শার্টটাকে দেখলে সব স্মৃতিগুলো যেন ফ্লাশব্যাক হয়ে সামনে আসে।“
বারাসাতের বুকে দাড়িয়ে থাকা এই প্রতিষ্ঠানটি ১৭৪ বছর ধরে কত স্মৃতির সাক্ষী। যুগে যুগে দিন পালটায় এক দল ছাত্রী আসে যায় কিন্তু এই স্কুলের দালানগুলো অবিকল একই ভাবে দাড়িয়ে থাকে। কী আর করা যাবে এই তো জীবনের নিয়ম। কোনো কিছুই থেমে থাকে না; সব কিছুই বহমান। যদি সত্যিই টাইম মেশিন বলে কিছু থাকত হয়ত আমরা এক বার হলেও ওই দিন গুলোতে ফিরে যেতে পারতাম।
Discussion about this post