ঝাড়গ্রাম শুনলেই মাথায় কেমন জানি ঘোরে খুন-মাওবাদী ভয় ও আতঙ্কের কেন্দ্রস্থল। জঙ্গলেঘেরা একখন্ড এই অঞ্চলটি জঙ্গলমহলেরই অংশ। লালমাটির পথে মিশে রয়েছে আদিবাসীদের সুর। সাঁওতাল, মল্লাস, ভূমিজ ও লোহিত আদিবাসীদের আবাসভূমি এই ঝাড়গ্রাম। আর এই জেলারই বিনপুর-১ ব্লকের সদর দপ্তর হল লালগড়। কংসাবতীর তীরে অতি প্রাচীন জনপদ এটি। আর এই লালগড়ের আশপাশ ঘিরে যে কত স্থাপত্যের ভিড় রয়েছে তা কল্পনাও করতে পারছেন না। একরাশ কারুকার্যময় মন্দিরের সমাবেশ এখানে। তাই লালগড়কে ‘মন্দিরময় লালগড়’ বললেও ভুল হবে না। আবার মন্দিরগুলোর সাথে আষ্টেপিষ্টে জড়িয়ে রমারমা বহু রাজকীয় ঐতিহ্য। সে ইতিহাস হয়ত আজো অনেকটাই অজানা সমগ্র বাংলার কাছে।
বহু আগে ‘সাহসরায়’ রাজাদের রাজত্ব চলত এই লালগড়ে। আনুমাণিক সাড়ে তিনশ বছর আগে রাজবাড়ির নিজস্ব ‘রাধামোহন জিউ’ এর একটি মন্দিরটি তৈরী হয়। বিষ্ণুপুরের জোড়বাংলা মল্লভূম মন্দিরের আদলে গড়া এটি। এক বিস্ময়য়কর স্থাপত্যশৈলী বলা যায়। কারণ এর গর্ভগৃহটি প্রাকৃতিকভাবেই শীততাপ নিয়ন্ত্রিত। মন্দিরে কানাইলাল ও শ্রীমতি ও কুলদেবীর নিত্য পুজোর আয়োজন হয়। এছাড়া সর্বমঙ্গলা দেবীর আদি দোতলা দালান মন্দিরটিও রয়েছে এখানেই। আবার প্রাসাদের পশ্চিম সীমানায় রয়েছে বছর পুরোনো রাজবাড়ির দেওয়ালী দুর্গা মন্দির। এটির বয়সও প্রায় তিনশো বছরের কাছাকাছি। রাজা স্বরূপনারায়ণ সাহসরায় ১৭১২ খ্রীষ্টাব্দে এটি নির্মাণ করেছিলেন। এই মন্দিরের গর্ভগৃহে রয়েছে চুন সুরকির তৈরী অপূর্ব এক দুর্গামূর্তিটি। এই লালগড়ের পাশের অঞ্চলই রামগড়। ১২ কিমি দূরত্বের ফারাক। এখানে আবার সিংহ সাহসরায়দের রাজত্বটি ছিল। এখানেও রয়েছে একঝাঁক মন্দিরের ছড়াছড়ি। আঠারো চূড়া বিশিষ্ট টেরাকোটার কালাচাঁদ মন্দির। যার দেওয়াল জুড়ে ইউরোপীয় চিত্রের বাহার। রাজা বাহাদুর সিংহ সাহসরায় ১২৬৩ বঙ্গাব্দের ২১ বৈশাখ গড়ে তোলেন এই কালাচাঁদ মন্দিরটি। রাজবাড়ির মধ্যে রয়েছে শতাব্দী প্রাচীন রাসমন্দিরের অবস্থিতি।
এছাড়াও অঞ্চল জুড়ে রয়েছে বুড়ো শিবের মন্দির, শীতলা মন্দির এবং রাধেশ্যাম মন্দির। রামগড় থেকে আরও কিছু দূরে মৌজিথানে বনদেবী মা মৌজি’র মন্দিরও বেশ পুরানো। ডাইনটিকরি নামের গ্রামটিতে রয়েছে মাকড়া পাথরের তৈরি সাতশ-আটশো বছর আগেকার একটি বৌদ্ধ উপাসনালয়। ওদিকে কংসাবতীর তীরে আজও দাঁড়িয়ে পঞ্চরথ পীঢ়া দেউল শৈলীর এক উপাসনালয়। যার উপরের ছাদ ৯টি ধাপে বিভক্ত এবং ভিতরের ছাদ লহরা পদ্ধতিতে বানানো। মন্দিরের একটিই প্রবেশদ্বার কোনও দরজা চিহ্ন নেই। তবে স্থানীয়রা বলেন, আগে লোহার দরজা ছিল। মন্দির সংলগ্ন একটি পাথরে বাঁধানো ভাঙাচোরা পাতকুয়োও দেখা যায়। মন্দিরের পাশে পড়ে থাকা মাটির পাত্রগুলো জানান দেয় বৌদ্ধভিক্ষুকদের আসর জমতো কোনো একসময়। লোকমুখে এও শোনা যায় এই মন্দিরে নাকি রংকিনি নামের এক রাক্ষসী থাকত। বিগ্রহশূণ্য এই মন্দিরটি তাই ‘রংকিনি মন্দির’ নামে পরিচিত।
লালগড় এত মন্দির ও স্থাপত্যের আখড়া হলেও সেভাবে যত্ন পেল না কোনোদিনই। রাজবাড়ির শরিকরা তাদের নিজস্ব মন্দিরগুলিকে দেখভাল করেন মাত্র। কিন্তু বাকি মন্দিরগুলির সত্ত্বাধিকারীদের অবহেলা ভীষনভাবে প্রত্যক্ষ। তাই প্রাচীন এই স্থাপত্য স্মৃতিগুলো ভেঙে পড়ছে একের পর এক। আর বেশি দেরি করলে হয়ত একদিন আদি বাংলার এই নিদর্শনগুলি নিশ্চিহ্নই হয়ে যাবে। বাংলার যে অংশটিকে খুব সহজে এক অনন্য পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা যেত সেটি এখনও সবার চোখের আড়ালে। বহুবার সরকারের দ্বারস্থ হয়েও লাভ মেলে নি খুব একটা। তাই স্থানীয়রা আজও অপেক্ষা করছেন সরকারি সাহায্যের। কারণ তাঁরা বাঁচিয়ে রাখতে চান প্রাচীন বাংলার গৌরবময় ঐতিহ্যের এই নিদর্শনগুলিকে।
চিত্র ও তথ্য ঋণ – শহর ঝাড়গ্রাম – The City Of Pride
Discussion about this post