কিছু মানুষের পা থাকে মাটি ঘেঁষে কিন্তু প্রতিভা যেন আকাশ ছোঁয়া। তেমনই এক গুণী সাধারণের নামই নিতে চলেছি। যাকে সামনাসামনি দেখতে পেলে অনেকে নাক সিঁটকোতেও পারেন। তেল চিটচিটে কোঁকড়ানো চুল ঘাড় অবধি ঝুলছে। গায়ে সাদা ধুতি ও সাদা কুর্তা। খালি পায়ে হেঁটে বেড়াচ্ছেন চানা- ঘুগনির দোকানে সামনে। এককথায় বলতে গেলে আপনার চোখ কোনোভাবেই টানবে না তাঁর দিকে। সেই ব্যক্তিটিই একদিন স্বয়ং হাজির হলেন রাষ্ট্রপতির সামনে। হাতে তুলে নিলেন ‘পদ্মশ্রী’ সম্মাননা।
১৯৫০ এর ৩১ মার্চ। ওড়িশার সম্বলপুর থেকে কিছুটা দূরে বরগড় জেলা। নিতান্তই এক হতদরিদ্র পরিবারে জন্ম নিলেন হলধর নাগ। ১০ বছর বয়সে মারা গেলেন বাবা। তখন তিনি তৃতীয় শ্রেণীতে পড়া এক বালক মাত্র। পড়া ছেড়ে রোজগারের পথে নামলেন। মিষ্টির দোকানে বাসন মাজা দিয়ে শুরু হল উপার্জনের। এরপর নিযুক্ত হলেন স্কুলের রান্নার দায়িত্বে। তখন তিনি ১৬ বছরের কিশোর। কিন্তু ওই সামান্য ক’টা টাকায় কি সংসারের সবার পেট চলবে? ব্যাঙ্ক থেকে কিছু ধার নিয়ে স্টেশনারি দোকান নিয়ে বসলেন। এর মধ্যেই পরিচয় হয় স্কুলে একসাথে কাজ করা মালতির সাথে। ভালোবেসে ফেললেন মালতিকে। মালতিও এই মানুষটির ভরসায় বিয়েতে রাজিও হন। সাধারণ এই জীবনে এল নতুন অতিথি তাঁর একমাত্র কন্যা নন্দিনী। ভাবছেন নিশ্চয়ই এসবের মধ্যে অসাধারণত্বটা কোথায়? এ তো নিছক এক গরিবের সাদামাটা গল্প। তবে বাকিটুকুও সেরে ফেলা যাক।
স্কুলের শিক্ষকদের পরামর্শে রান্নার কাজ ছেড়ে বইখাতার দোকান খুলেছেন তিনি। সেই থেকেই শুরু হল তাঁর সাহিত্যচর্চা। ছোট থেকেই আঞ্চলিক কোশলী ভাষায় গল্প লিখতেন। অর্থাৎ প্রতিভার আবির্ভাব সেই ছোট থেকেই। কিন্তু এত বছর অভাবের তাড়নায় তা চাপা পড়েছিল। ফের আঁকড়ে ধরলেন অসম্পূর্ন সেই ভালোবাসাকে। বইখাতার দোকানে বসে লিখে চললেন একের পর এক কবিতা। ‘ধোদো বরগাছ’ অর্থাৎ বুড়ো বটগাছ প্রথম কবিতা যা স্থানীয় ম্যাগাজিনে প্রকাশ পেল। ধর্ম, প্রকৃতি, সমাজ, মানুষের জীবন এমন নানা বিষয়কে নিজের ভাষায় নিজের ছন্দে লিপিবদ্ধ করে চললেন। ‘লোককবি রত্ন’ নামে ছড়িয়ে পড়ল তাঁর নাম। তাঁর লেখা মোট মহাকাব্যে কুড়িটি। সবকটিই লিখেছেন নিজের মাতৃভাষা অর্থাৎ কোশলী ভাষায়। কিন্তু মজার কথা কি জানেন! সেদিনের তৃতীয় শ্রেনী থেকে স্কুল ছুট ছেলেটার লেখা আজ গবেষণার বিষয়বস্তু। বর্তমানে ১৪ জন স্কলার গবেষণা করছেন তাঁর লেখা নিয়ে। এমনকি ৫ জন পিএইচডি ডিগ্রীটিও পেয়েছেন তাঁরই সৃষ্টিসম্ভার নিয়ে কাজ করেই। তাঁর লেখনশৈলীতে তৈরী হয়েছে নতুন এক কাব্যধারা, ‘হলধর ধারা’। তাঁর লেখা আজ সম্বলপুর বিশ্ববিদ্যালয় স্নাতকোত্তর পাঠ্যসূচীতে রেখেছে। ২০১৬ তে মাথায় উঠল সেরার সেরা পদ্মশ্রীর মুকুটটিও। কিন্তু একবিন্দু বদল ঘটেনি তাঁর যাপনের। এখনও একরকম ঘুগনি বেচতে দাঁড়িয়ে পড়েন রাস্তায়। আজও সেই বইখাতার দোকানটিতে দেখা যায় তাঁকে। সত্যি এ যেন এক স্বপ্নে দেখা কাহিনী। হলধর নাগের এই জীবনী আগামী প্রজন্মের কাছে এক চূড়ান্ত দৃষ্টান্ত হয়ে থাকুক।
Discussion about this post