‘আম’ শব্দের সঙ্গে অমৃতের কোনো যোগাযোগ আছে কিনা জানা নেই। কিন্তু কবির মতো করে দুধে আমসত্ত্ব, কলা আর সন্দেশ মাখিয়ে খেলে তা অমৃতের থেকে কিছু কম মনে হবে না। সাধেই কি সে ফলের রাজা নামে খ্যাত? আর রাজার সাম্রাজ্য থাকবে না তাই বা কী করে হয়! বাংলায় এই রাজার অন্যতম রাজত্ব মুর্শিদাবাদকে তাই ভুললে চলবে না। দিল্লীর সুলতানদের যেমন ছিল কোহিনুর, তেমনই বাংলার নবাব রাজ্যের ফলের রাজাদের রয়েছে কোহিতুর। মুর্শিদাবাদের এই বিখ্যাত আমটির কথাই আজ জানবো!
মুর্শিদকুলি খাঁ ১৭০৪ সালে বাংলার রাজধানী ঢাকা থেকে মুর্শিদাবাদে স্থানান্তরিত করেন। নবাবের রাজ্যে নবাবি খানা থাকবে না তা হয়? তবে আম যতই হোক ফলের রাজা, রাজাদের মধ্যেও তো দ্বন্দ্ব থাকে। কে শ্রেষ্ঠ রাজা সেটা নিয়ে একটা লড়াই তো থাকেই। বাংলায় আম রাজাদের রাজত্বে এই লড়াই জিতে নিয়েছিল মুর্শিদাবাদের এই কোহিতুর আম। এক বেনামি মালির দ্বারাই এই আমের ফলন শুরু হয়৷ শিশুর মতো যত্ন করে রাখা হয় এই রত্ন আমকে। আম পাকার আগে অতি কৌশলতার সাথে পেড়ে নিয়ে, খুব শৌখিন ভাবে তুলোর মধ্যে জড়িয়ে রাখতে হয়। মাঝে মাঝে উল্টে উল্টে রাখতে হয় আম গুলিকে, একই দিকে বেশিক্ষন রাখলে আমের স্বাদ নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। আবার আমকে সাধারণ চাকু দিয়ে কাটলেও আমের আঁটিতে আঘাত লাগতে পারে তাই বাঁশের কঞ্চি দিয়ে কাটা হত। তবে এই আম সেভাবে কখনোই জনপ্রিয়তা পায় নি। যদিও বর্তমানে কলকাতায় এই আম দেখতে পাওয়া যায়, তবে তা এতোই শৌখিন যে সাধারণ মানুষের ধরা ছোঁয়ার বাইরে।কলকাতার আম উৎসবে এবং মাঝে মাঝে নামী দামী হোটেলে অবতীর্ণ হন এই আমের রাজা। বিদেশে রপ্তানিও করা হয় বাংলার এই নবাবি আমেদের।
তবে দুঃখের বিষয় যে আমেদের নবাবি হীরে কোহিতুরের সংখ্যা এখন সারা মুর্শিদাবাদ জুড়ে হয় তো ১০০ এর কাছাকাছি এসে ঠেঁকেছে। হিমসাগর, ল্যাংড়া ইত্যাদি আমের বাজারে এই আম কোথাও যেন হারিয়ে গিয়েছে। তাছাড়া এই আম যতটুকু উৎপাদন হয় প্রায় অনেকটা অংশই বাইরে চলে যায় অথবা কলকাতায় আনা হয়। তবে মুর্শিদাবাদের অনেকে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছেন এই আমের স্বাদও আর আগের মতো নাকি আর নেই। আমের সাথে বাঙালির এক অদ্ভুত টান জড়িয়ে আছে। আম শুনলেই তাই বারবার রবি ঠাকুরের সেই বিখ্যাত কবিতার লাইন গুলো মনে পড়ে যায়- “সেই মনে পড়ে জ্যৈষ্ঠের ঝড়ে রাত্রে নাহিক ঘুম— অতি ভোরে উঠি তাড়াতাড়ি ছুটি আম কুড়াবার ধুম”। ঝড়ে কুড়িয়ে আনা কাঁচা পাকা টক আমের সাথে নুন লঙ্কা মিশিয়ে বন্ধুদের সাথে আড্ডাগুলোর মতোই বেঁচে থাকুক বাংলার এই নবাবি আম কোহিতুর।
চিত্র ঋণ – অনির্বাণ চৌধুরী
Discussion about this post