বাংলার ইতিহাস বলতেই প্রথমে আসে নবাবী শহর মুর্শিদাবাদের কথা। বাংলা অবশ্য তখন বাংলা বিহার উড়িষ্যার সম্মিলিত সাম্রাজ্য। আর সেই সাম্রাজ্যের প্রাণকেন্দ্র অর্থাৎ রাজধানী ছিল এই মুর্শিদাবাদ। জানা যায় নবাব মুর্শিদকুলি খাঁয়ের নাম থেকেই এই ‘মুর্শিদাবাদ’ নামকরণটি হয়েছে। আজও মুর্শিদাবাদের মাটি ইতিহাসের শত সহস্র অজানা রহস্যের গন্ধে ভরপুর। এখানে পা রাখলেই ব্রিটিশ আমলের গোলা বারুদমাখা বাতাস এসে ধাক্কা মারে ফুসফুসে। একের পর এক নির্বাক স্মৃতিসৌধ। সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকা মসজিদের গম্বুজ। এককথায় ইতিহাসের আসল ছোঁয়া পেতে মুর্শিদাবাদের জুড়ি নেই। সেই মুর্শিদাবাদেরই এক অতি পরিচিত স্থান হল কাঠগোলা বাগানবাড়ি।
হাজারদুয়ারি থেকে উত্তরে ৪ কিমি গেলেই পাওয়া যাবে বাগান ঘেরা এক সুবিশাল স্থাপত্য। নবাবী আমলে লক্ষ্মীপৎ, জগপৎ, মহীপৎ ও ধনপৎ এই চার বর্গী ভাই নবাবের থেকে বারো শ টাকায় এই অঞ্চলটি কিনেছিলেন। উদ্দেশ্য ছিল বিশাল মাপের জৈন মন্দিরের নির্মান। কিন্তু ধীরে ধীরে আড়াই হাজার বিঘার সম্পত্তির মালিক হয় এই চার ভাই। মন্দিরের সাথে তাই সুসজ্জিত এক প্রাসাদ, চিড়িয়াখানা, সুড়ঙ্গপথ এসবও তৈরী হয়। সেসময় এই বিশাল বাগান জুড়ে গোলাপ, জুঁই, চামেলীর মতো চমৎকার সব ফুলের চাষ হত। বাংলায় ফুলের একমাত্র আড়ত ছিল এই কাঠগোলা বাগানবাড়ি। এছাড়াও এখানে শ্বেতপাথরের তৈরী সুন্দর বাঁধানো ঘাট ও পালঙ্ক আজও প্রত্যেককে মোহিত করে।
শৌখিন কারুকার্যময় ভাস্কর্য, মার্কারি গ্লোব, তৈজসপত্র, লক্ষ্মীপুর সিং দুগার এর সুদৃশ্য খাট ,বিশাল বড় আয়না, বিলিয়ার্ড বোর্ড, খাবার টেবিল, পোশাক রাখার আলমারি, ঝাড়বাতি, গ্যাস বাতি, তৈলচিত্র ও একটি লাইব্রেরীর সম্ভারও রয়েছে এখানে। সত্যি বলতে প্রতি বস্তুর মধ্যে লুকিয়ে থাকা শৈল্পিক কৌশলে আজও তাজ্জব প্রতি দর্শনার্থী। নাচ গানের আসরের জন্য গড়া হয়েছিল নিপুণভাবে সাজানো এক ডান্সফ্লোর যা বেলজিয়ান গাছ দিয়ে ঢাকা থাকত। যেখানে পাটনা, লক্ষ্ণৌ থেকে পটিয়সী নর্তকীরা আসতেন নৃত্য প্রদর্শন করতে। শোনা যায় মীরজাফর এখানে এসেই মুন্নি বাঈয়ের রূপে ও নৃত্যে মুগ্ধ হয়ে তাঁকে বিয়ে করেন। আর এই বাগানবাড়িতেই চলত ব্রিটিশদের সাথে নবাবী আমল ধ্বংসের নানা ষড়যন্ত্রমূলক পরিকল্পনা। বর্তমানে লক্ষ্মীপত সিং দুগারের বংশধর সিদ্ধার্থ এবং সঞ্জয় সিং এ তল্লাটের দেখভাল করেন।
সময় পেরিয়েছে অনেক। কিন্তু কোথাও যেন আজও মুর্শিদাবাদের শরীরে বিশ্বসাঘাতকতার দাগ লেগে। এক প্রতাপশালী সাম্রাজ্যের শেষ হওয়ার অধ্যায় গেঁথে। ব্রিটিশ শাসন থেকেই মুর্শিদাবাদের গুরুত্ব বাংলার কাছে ক্রমশ কমেছে। আজ সে পুরোনো স্মৃতি ঘেরা এক ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট মাত্র। তবে বাঙালির কাছে আজও মুর্শিদাবাদের ইতিহাস গৌরবের ও সম্মানের।
চিত্র এবং তথ্য ঋণ – কুদরৎ এ খুদা, বাংলাদেশ
Discussion about this post