দাঁত থাকতে দাঁতের মর্ম বোঝা প্রবাদের সাথে তো আমরা পরিচিত। আক্ষরিকভাবে এই প্রবাদের মানে যাই হোক না কেন, এটা ঠিক যে না থাকার কষ্ট প্রবল। আর এই দাঁতকে সুন্দর ঝকঝকে রাখতে বাজারে কতরকমের পণ্য সামগ্রীই বেরিয়েছে। চুইং গাম থেকে টুথপেষ্ট কত বিজ্ঞাপন এই দাঁতকে ভালো রাখতে। কোনোটিতে নুন রয়েছে, কোনোটিতে আবার আছে লেবু কিংবা পুদিনা। তবে যদি পিছনে ঘুরে তাকাই একটা প্রশ্ন মনে জাগে যে আগেকার দিনে চিকিৎসা বিজ্ঞান ততটা উন্নত ছিল না। তখন কি মানুষের দাঁতের সমস্যা হত না। হ্যাঁ, অবশ্যই হত! তবে তার সংখ্যা কমই ছিল, তার একটি বড়ো কারণ তখনকার নির্ভেজাল খাদ্যভ্যাস। কিন্তু তবুও শরীরকে যন্ত্রের সঙ্গেই তো আমরা তুলনা করি। আর যন্ত্রের মতোই মানুষের শরীরেও যান্ত্রিক ত্রুটি হয়। তাহলে কীভাবে তখন চিকিৎসরা দাঁতের চিকিৎসা করতেন?
প্রথমেই আসা যাক প্রাচীন মিশরের দন্ত চিকিৎসার কথায়। প্রাচীন মিশরের নানা প্রত্নতাত্বিক খননকার্যের মাধ্যমে উঠে আসা মৃতদেহগুলি নিয়ে গবেষণা করা হয়৷ জানা যায় মিশরীয়দের দাঁতের ক্ষয় হত প্রচুর পরিমাণে। যথারীতি তাদের নিম্নমানের খাদ্যভ্যাসকেই দায়ী করা যায় এর জন্য। তাছাড়া খাবারে ছিল ভিটামিনের ও খনিজের অভাব। ‘এবার’স প্যাপাইরাস’ নামক গ্রন্থে মিশরীয় প্রায় চিকিৎসার ১১ টি পন্থা সম্বন্ধে জানা যায়। থেকেই জানা যায় যে নড়বড়ে দাঁত ঠিক করতে তারা ‘ফিলিং’ পদ্ধতি ব্যবহার করতেন। যার ফিলিংটি তৈরি হত বারলি, মধু ও অ্যান্টিসেপ্টিক দিয়ে। এমনকী ব্যথা কমানোর জন্য ও দাঁতকে সুস্থ রাখার জন্য ব্যবহার করা হত নানাধরনের সিরাপ ও মাউথওয়াশেরও। ভেষজ পদ্ধতিতেই শুধু আবদ্ধ ছিল চিকিৎসা ব্যবস্থা তা নয়, সেই সময়ে দাঁতে জমা হওয়া পুঁজ সারানো হত ড্রিল করে। অস্ত্রোপচারও করা হত আধুনিক প্রযুক্তির মতোই। ভাবলে অবাক লাগে খ্রিস্টপূর্ব ২৫০০ সালেও দাঁতের জন্য স্কালপেল ও ফরসেপের মতো যন্ত্রপাতি ব্যবহার হত। পড়ে যাওয়া দাঁতের জায়গায় সোনা অথবা রূপোর দাঁত বসানোর নিদর্শন পর্যন্ত দেখা গিয়েছে এখানে।
এরপর আসা যাক মায়া সভ্যতায় দাঁতের চিকিৎসা পদ্ধতির কথায়। এতো প্রাচীন সভ্যতা হওয়া সত্ত্বেও তাদের ফিলিং, দাঁতের পাথর পরিষ্কার ও দাঁত তোলার পদ্ধতিতে দক্ষতা ছিল। প্রত্যেকটি কাজের জন্য আলাদা আলাদা যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা হত। চোয়ালের দাঁতে ঝিনুক ব্যবহার করে দাঁতের ইমপ্ল্যান্ট করা হত। শুধু এই নয়, দাঁতকে আরো সুন্দর করতে তারা দাঁতের জন্য বিভিন্ন অলঙ্করণ ব্যবহার করত, দাঁতে ফুঁটো করে বসানো হত নানা রকমের মূল্যবান পাথর। যদি আমরা গ্রীক সভ্যতার দিকে নজর দিই, তাহলে দেখবো দাঁতের সমস্যা নিয়ে তারাও যথেষ্ট জর্জরিত ছিল। কিন্তু তাদের কাছে এই দাঁত সংক্রান্ত ব্যথা বেদনা ও তার চিকিৎসা করানো ছিল লজ্জাজনক। নিজেদের দুর্বলতা প্রকাশ না করে যন্ত্রণা নিয়েই নিজেদের সুন্দর ও শক্তিশালী করে তুলে ধরাই তাদের কাছে শ্রেয় ছিল।
প্রত্নতত্ত্ববিদদের বিভিন্ন গবেষণায় জানা যায় যে মিশরে রোগ থেকে মৃত্যু হয়েছে এমন মৃতদেহের সন্ধান তারা পেয়েছেন। গ্রীক চিকিৎসক হিপোক্রেটস ও বিজ্ঞানী দার্শনিক আরিস্টটল দাঁতের চিকিৎসা পদ্ধতি নিয়ে লেখা শুরু করেছিলেন। মাড়ির রোগ, দাঁতের গর্ত থেকে শুরু করে আরো জটিল দাঁতের সমস্যা সমাধানের কথা তাঁরা লিখে গেছেন। হিপোক্রেটসের চিকিৎসা পদ্ধতি অনুসরণ করেই তারা দাঁতের বিভিন্ন রোগ নিরাময় করত। কী আশ্চর্য্য যে তখনকার সময়ে মানুষ দাঁতকে সুন্দর রাখার জন্যও যথেষ্ট তৎপর ছিলেন। দাঁতকে অলঙ্কার দিয়ে সাজিয়ে নিজেদের সুন্দর দেখাতে তারা যথেষ্ট উৎসাহী ছিলেন। এক কথায় বলতে গেলে তারা দাঁত থাকতে দাঁতকে মর্ম দিতেন।
চিত্র ঋণ – British Dental Association Museum, হাফিংটন পোস্ট
Discussion about this post