কলেজের সেই হুল্লোড়ে ভরা ‘ক্যান্টিন অনার্স’ কিংবা ‘ক্লাসরুমে’র ছোঁড়া চিরকুট। একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকা কাজল মাখা কোনো এক ‘রাজকন্যা’র প্রেমে পাগলামো। বছর ঘুরলেও স্কুল বা কলেজের গায়ে নতুন রঙ চড়লেও বদলায় না কিছু ‘স্মৃতি’। হ্যাঁ এই সব কিছুকে নিয়েই যৌবনের পথচলা শুরু হয় আমাদের। আমাদের ভালোবাসার সেই ফেলে আসা ঠিকানাকেই আবার খোঁচা মেরে জাগিয়ে তোলে ক্যালকাটা ব্লুজের কিছু গান। যে কথাগুলো কোনোদিনই প্রকাশের সুযোগ ছিল না তাকেই সুরের বাঁধনে বেঁধেছিল এই অতি পরিচিত বাংলা ব্যান্ডটি। চলুন আজ তবে ক্যালকাটা ব্লুজের অন্যতম লিডিং ভোকালিস্ট ইমন সেনের সঙ্গে আড্ডায় যাওয়া যাক। জেনে নেওয়া যাক টক-মিষ্টি-ঝাল কিছু প্রশ্নের উত্তর।
গানের বিষয় হিসেবে কোন টপিকগুলো ক্যালকাটা ব্লুজের মগজে ধাক্কা দেয়?
ক্যালকাটা ব্লুজের গানের বিষয়ের ক্ষেত্র বলতে গেলে আমরা সবসময় চেয়েছি মানুষের মনের কথাগুলোকে টেনে মুখ অবধি নিয়ে আসতে। তারমধ্যে প্রেম আছে, মায়ের ভালোবাসা আছে, কলেজ ক্যান্টিন, ইউনিয়ন সবটাই আছে। তবে প্রেমের ভাগ বেশি, অন্ততঃ মানুষ তো তাই মনে করে। কিন্তু সঙ্গীতের ইতিহাসে দেখো প্রেম বিষয়টাই বরাবর এগিয়ে। বিটলস, জন লেনন কি আমাদের মহীনের ঘোড়াগুলি প্রেমকে একদম উঠেক্ষা করতে পারেনি কেউ। তবে আমাদের যে গানে বিপ্লব এসেছে, ‘ক্যান্টিন অনার্স’ সেটা কিন্তু নিখাদ প্রেমের গান বললে ভুল হবে। কলেজ ক্যাম্পাসের অলিগলি জড়িত। আবার ‘মধ্যরাত’, ‘রাজকন্যা’ এগুলোও প্রেমের গান নয় কিন্তু বেশ জনপ্রিয়তার শিখরে এসেছে।
আপনাদের ব্যান্ডের কোন কোন কাজ বা পরিকল্পনার জন্মদিন আমরা দেখতে পাব?
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে আমি এখনি কিছু বলতে চাইছি না। ফলপ্রসূ হোক সম্পূর্ণতা পাক, তার আগে মুখ খোলা মুশকিল। কারণ বিগত কয়েক বছর বাংলা ব্যান্ডের অন্ধকারাচ্ছন্ন একটা সময় চলছে। ট্যালেন্ট প্রতিটা দলের মধ্যেই রয়েছে। কিন্তু সেটাকে একটু ঘষামাজা করতে হবে এটুকুই বলতে পারি। আমি কাউকে ছোটো করছি না কিন্তু কিছুজন শুধু ওই ইউটিউব প্লাটফর্মে আটকা পড়ে। ওদের লাইভে নিয়ে এলে মানুষ কিন্তু সেভাবে আর ভালোবাসতে পারছে না। ইউটিউবে ফাঁকি দেওয়া যায় অনায়াসে স্টুডিওর ঘরে বসে। কিন্তু লাইভ পারফর্ম্যান্সে তা এক্কেবারেই অসম্ভব। আমাদের পরিকল্পনা অনেক লাইভ পারফর্ম করতে চাই ভবিষ্যতে ব্যাস। কাজ তো ভালোই চলছে। চলতি মাসে তিনটে শো করেছি। তবে বড় মাপের উপহার আসতে চলছে ক্যালকাটা ব্লুজের তরফ থেকে আগাম জানালাম। শ্রোতাদের একটু সাথ চাই, পাশে চাই তাতেই হবে।
এই সময় আমার আপনার দেশ এক ফ্যাসিষ্ট আগ্রাসনের মধ্যে দাঁড়িয়ে। এই পরিস্থিতিতে সাংস্কৃতিকভাবে হলেও যৌথবদ্ধ কেন হয়ে উঠতে পারছে না?
মানুষ আসলে একটু বেশিই কাছে চলে এসেছে ফেসবুক হোয়াটসঅ্যাপে। যত ভার্চুয়াল কাছে এসেছে দূরত্ব বেড়েছে শারীরিকভাবে। মানুষের ধৈর্য্যটা তো এখন নেই বললেই চলে। আগের দিনের মত সেই যে একটা গান রিলিজের জন্য অপেক্ষা সেটা কোথায় আর? আবার একটা গোটা ক্যাসেট রিল ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে পুরোটা শুনে তবে শান্ত হতাম। কিন্তু এখন মানুষ ৪ মিনিটে ১০টা গান শোনে। ৪০ সেকেন্ডের বেশি সময়ের ভিডিও হলেই বাতিলের খাতায়। আমাদেরও সেটাই করতে হচ্ছে বাধ্য হয়ে। কিন্তু এভাবে তো আর শিল্প হয়না। এই সোশ্যাল মিডিয়া এসেই মানুষকে মানুষের থেকে দূরত্বে নিয়ে যাচ্ছে। প্রেম তো ফেসবুকে শুরু হোয়াটস্যাপে ব্লক হয়ে শেষ। তো যারা এই সোশ্যাল মিডিয়ার বাইরে বেরিয়ে সাধারণ যাপনটাকে আত্মস্থ করতে পারছে তাঁরাই থাকছে। তো মানুষের মূল স্রোতে ফেরাটা খুব দরকার। নইলে আগামীতে কোনোভাবেই আর সুযোগ নেই যৌথ হওয়ার।
রিয়েলিটি শো কি শিল্পী তৈরী করে নাকি তারকা তৈরী করে?
ভারী মজার প্লাটফর্ম ওটা। না শিল্পী না তারকা ওরা আসলে বিজ্ঞাপন তৈরী করে। কার বাবা কোথায় চাকরি করে, কে সিকিউরিটি গার্ড এসবকেই খুঁজে বেড়ায়। বাংলাদেশি একটা ছেলেকে কী ভীষণ রকম প্রোজেক্ট করল। ট্যালেট খোঁজে না টিআরপি খোঁজে ওরা। একসময় বাংলা ব্যান্ডকে যাচ্ছেতাই রকম হেয় করত। কিন্তু পরে সারেগামাপা এর মিউজিক প্রোডাকশন হাউসে যে সাউন্ড তৈরি হচ্ছে, তা একদমই বাংলা ব্যান্ডের আঁতুড়ঘর এখন। শুরুর দিকে কিন্তু রিয়েলিটি শোয়ের একটা সৌন্দর্য বৈচিত্র ছিল। আমিও ছোটোবেলায় এম টিভির রক অনে অডিশন দিয়েছি। ভুল ঠিক লাইভ গাইতে হত। কিন্তু এখন রেকর্ডিং বাজিয়ে শিল্পীরা লিপ দেয় তাতে। এতে কি বিচার করা যায়? তারউপর স্টেজ জুড়ে যেন যাত্রাপালা চলছে। কে শাঁখ বাজাচ্ছে কে নাচছে হুল্লোড়বাজি হচ্ছে। মিউজিককে একটা সার্কাস বানিয়েছে। সত্যি বলতে যারা গানকে ভালোবাসে তাদের এসব নাটকবাজি একদম সহ্য হয়না। অনেক ট্যালেন্টই তাই এই মিথ্যে ইন্ডাস্ট্রি ছেড়ে অন্য কাজ খুঁজে নিচ্ছে।
নতুন বাংলা ব্যান্ড যখন পারফর্ম করতে যায় নতুন বলতে যারা সেভাবে পরিচিতি পায়নি পেমেন্টের ক্ষেত্রে বৈষম্যের স্বীকার হন অনান্যক্ষেত্রেও হন। এটাকে আপনি কি চোখে দেখেন?
এটা সম্পূর্ণ ব্যান্ডগুলোর মুদ্রাদোষ বলা যায়। দু-চারটে গান রিহার্সেল করে ফ্রীতে স্টেজ শো করে বেড়ায়। আর একবার যদি ফ্রী শোয়ের তকমা লেগে যায় তুমি তবে গেলে। তখন দু’পয়সা চাইলেও কেউ দেবে না। যেখানে মরতে গেলে বিষটাও তোমায় কিনে খেতে হয় সেখানে মিউজিক কেন ফ্রী হবে? ফ্রীতে কিস্যু হয়না এযুগে। তাই প্রাথমিক পর্যায় থেকেই শক্ত হও। ওই বিরিয়ানির লোভে গান গাইতে চলে গেলাম, ওসব করলে হবে না। কম হলেও ৫০০ টাকা হলেও তোমায় দাবি করতেই হবে পারিশ্রমিক।
এই মূহুর্তে বাংলায় দু-তিনটে বা আর একটু বেশি লিডিং ব্যান্ড বাদে অন্যকোনো ব্যান্ড চোখে পড়ছে না সেভাবে। অথচ এক দশক আগের সময়কে বলা হত বাংলা ব্যান্ডের গানের স্বর্ণযুগ। সেটা কি ফুরিয়ে যাওয়ার পথে?
দেখো ওভাবে স্বর্ণযুগ বলে কিছু হয়না। একটা সময় থাকে দশা থাকে। সবকিছুই তো পরিবর্তন হয়। মানুষের পছন্দ রুচি সংস্কৃতি সবটাই কখনো স্থির নয়। এই যে ‘হ্যাপি টু ডিসটার্ব’, ‘সানডে সাসপেন্স’ মানুষ একটা সময় গিলছিল রীতিমতো। এখন যেমন সিনেমার চেয়ে ওয়েব সিরিজে ঝোঁক বেশি। এসব উপর নীচ হতেই থাকবে। লাকি আলী হঠাৎ করে পঁচিশটা বছর পর আবার লাইমলাইটে। আমি বিশ্বাস করি কাজটাই আসল। ভালো গান ভালো সুর পেলেই মানুষ ছুটবে। কোনো বিশেষ যুগ বা সময় নেই বলে আটকাবে না। যেটা সমস্যা সেটা হলো মানুষের ধৈর্য্য নেই আগেও বললাম। আগে নজরুল মঞ্চে ওৎ পেতে বসত মানুষ। কিন্তু এখন তো সব চার দেওয়ালে বন্দী। তো বাংলা ব্যান্ডও হয়ত তাদের প্লাটফর্ম বদলে নেবে। ঘরে বসেই যাতে মানুষ আনন্দ পেতে পারে তেমন প্লাটফর্ম তৈরী করবে। হয়তো ব্যাক টু ব্যাক আমার, ক্যালকাটা ব্লুজের, রূপমদা, কৌশিকদা যত ব্যান্ড আছে মিউজিক ভিডিও বের করবে ইউটিউবে।
কলেজ ক্যান্টিন অনার্সের সেই স্মৃতির বাইরে কতটা বেরতে পেরেছে ক্যালকাটা ব্লুজ?
প্রত্যেকেরই কিছু গান তার পরিচিতি হয়ে ওঠে। পরে যতই নতুন গান বের করুক না কেন স্টেজে আবদার আসবেই দর্শক থেকে ওই গানটার জন্য। রূপম ইসলাম এলেই ‘একলা ঘর হাসনুহানার’ নাম উঠবে। অনুপম রায় বললেই ‘আমাকে আমার মতো থাকতে দাও’ কিংবা ‘বাড়িয়ে দাও তোমার হাত’। এবার আমার এত বিশাল কালেকশন নেই গানের। মেরেকেটে কুড়িটা হবে। তো তারমধ্যে স্মৃতি রাজকন্যা নিয়ে মানুষের পাগলামোটা বেশিমাত্রায় পৌঁছেছে। আর ‘ক্যান্টিন অনার্স’কে আমরা ছাড়তেই পারবো না। ওটা আমাদের একটা আলাদা ভালোলাগা। মানুষ চিনিছে ওর হাত ধরেই। আমাদের দিন শেষের আশ্রয়ের জায়গা ওটা। আর গানের কথাগুলো এমনই যে প্রতিবছরে কলেজের ছেলেরা সহজে ঢুকে পড়তে পারবে এই গানে। আগামী ৫০ বছরও ওর রেশ থাকবেই। কিন্তু আমরা এর গন্ডী ছেড়ে বেরোইনি এটা ভুল। ‘একতরফা’ কিংবা মোটিভেশনল ভিডিওগুলো এত ছড়াতো না। লোকে যদি শুধু ‘ক্যান্টিন অনার্স’ নিয়েই আমায় চেনে আমি খুশিই হব। বুড়ো বয়সেও ওই গান গেয়ে আমি নিজেকে কলেজ স্টুডেন্ট মনে করতে চাই।
অতিরিক্ত সফটওয়্যার এবং অ্যাপস নির্ভরতা কোথাও গিয়ে কি গানের ক্ষতি করছে?
আচ্ছা এই বিষয়ে একটা ঘটনা বলি তবে। গত বছরের ফেব্রুয়ারীতে আমরা স্টেজ শোতে গিয়েছিলাম। তো আমরা ব্যাক স্টেজে বসে। এক ভীষন জনপ্রিয় ইউটিউবারের স্টেজ পারফরম্যান্স চলছে তখন। তার গান আমি ইউটিউবে শুনেছি আগে। কিন্তু স্টেজে ওঠার পর আকাশ পাতাল তফাৎ গলার। লাইভ করতেই পারছে না। লোকে কি আর তাদের ডাকবে? ১টা ২টোর বেশি ডাক পায়ই না ওরা। এরা আসলে স্টুডিও পার্ফমার। সলমন খানও স্টুডিওতে গান গাইছে এখন। এতোই কি সোজা সবটা? একটা শিল্পীর স্ট্রাগলটাকে ছাপিয়ে বেরোয় তার সুর। খিদে পেটে বসে গান বাঁধার অধ্যাবসায় সেগুলোর ছাপ তো থাকে গানের লিরিক্সে। রক্ত ঘাম এক করে খাটনিগুলোকে অনুভব না করে শিল্পী হওয়া যায় না। কত ছেলেমেয়ে অলিগলিতে কি দারুণ সব গান বাঁধছে। সৌমদীপদের ব্যান্ড কি ভালো কাজ করছে। কিন্তু ভিউয়ার্স ১১০০। অথচ কভার গানে মিলিয়ন ভিউয়ার্স। টুম্পা, টুনিতে ভিউয়ার্স কত একবার দেখো সেখানে। এসব আজ আছে কাল থাকবে না। ভালো কাজ ভালো গান কিন্তু যুগ যুগ মানুষ গাইবে।
শেষ প্রশ্ন কান পাতলে বাংলা ব্যান্ড সঙ্গীতকে ঘিরে নানাকিছু পলিটিক্স লক্ষ্য করা যায় বা শোনা যায়। এটিকে আপনি কোন চোখে দেখেন?
পলিটিক্স রাজনীতি এসব ঘরেও থাকে। তুমি এক পা ফেললেই তার সামনে পড়বে। মা ছোট ছেলেকে ভালোবেসে বড় মাছের পিস দিচ্ছে। দোকানে এক ঘন্টা লাইন দাঁড়িয়ে তুমি কেউ পরে এসে টুক করে নিয়ে কেটে পড়ল। পলিটিক্সেরই তো বাজার এখন। তাই প্রত্যেকেরই উচিৎ যে কোনো সমস্যার সামনে দাঁড়াতে হবে। পিছোলে একদম চলবে না। আর জীবনের নিশ্চয়তা কোথায়! আজ আছি কাল নাও থাকতে পারি। প্রতি মূহুর্তে তাই আমাদের কাজ করে যেতে হবে। এবার ওই নিখাদ রাজনীতি মোদী মমতা রাহুল গান্ধীর যেমন হয় তেমনটা তো নেই, এখানে অন্যরকম। যে উঠছে তাকে এড়িয়ে চলো। পেপারে নাম উঠতে দেব না। আর বাংলা ব্যান্ডে কোনো কালেই কোনো মিডিয়ার সাহায্য আসেনি। সবসময় অবহেলা কুড়িয়েছে। যেখানে প্রীতম বাংলা ব্যান্ড থেকে গিয়ে মুম্বাই কাঁপাচ্ছে। কতজন উঠেছেন এই ব্যান্ড থেকে। যারা পরিচিতি পেয়েই গিয়েছে সেই চন্দ্রবিন্দু, ক্যাকটাস, ফসিলস তাদের নিয়েই মেতে কাগজ। নতুনদের দিকে ফেরেই না। ছিটকে পড়া প্রতিভাগুলোর কাছে যাওয়াও তো দরকার। বিরাট কিছু করলেই তবেই গদগদ করে নিউজ পেপার ভরবে। এমনটা কেন হবে?
যতদিন কলেজ-ক্যান্টিন থাকবে, থাকবে উন্মাদ প্রেমিক-প্রেমিকার দল, যতদিন চেনা অচেনা মুখের মাঝে চোখ লোকানো থাকবে, যতদিন পুরোনো স্মৃতিরা মাঝেমধ্যেই মাথায় গজগজ করে উঠবে ততদিন ক্যালকাটা ব্লুজের অস্তিত্ব থাকবে। তাদের গান তো কোনো কঠিন কাব্যের সারাংশ নয়, সোজা সাপ্টাতেই গভীরতা তুলে ধরার প্রচেষ্টা। অগোছালো দিনে ক্যালকাটা ব্লুজ তথা ইমন সেনের আরও মনকাড়া নতুন-পুরনো গানের সঙ্গী হতে চাইবে যে কেউ। কাজেই অপেক্ষার পালা চলতেই থাকবে ক্যালকাটা ব্লুজ-প্রেমীদের মননে।
সম্পাদনা – অনন্যা করণ, কভার চিত্র ঋণ – সৌগত সিংহ
Discussion about this post