ভালোবাসার মরশুমে সব ফিকেই যেন কেমন হঠাৎ করে রঙিন হয়ে উঠেছে। ভালোবাসার মানুষকে কীভাবে খুশি করা যায় চলছে তারই শেষ প্রস্তুতিপর্ব। কিন্তু ভালোবাসা কি শুধুই উপহার কিংবা একসাথে কাটানো কিছু সময়? কিংবা দীর্ঘ প্রেমের পর শুভ পরিণয়। ভালোবাসার উদাহরণ বলতে এসবই তো বোঝায় তাই না? কিন্তু কাছের মানুষটিকে চিরকালের জন্য হারিয়েও যে তাকে ভালোবাসা যায় তার নজির বোধহয় হাতে গোনা। সেই গুটিকতকের মধ্যেই একজন হলেন মারিয়া ভাসিলয়েভনা অক্টিয়াব্রিস্কায়া। বড় বড় কামান গোলার সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়ানো এক সৈনিক তিনি। ত্রিশোর্ধ্ব এক মহিলা স্বেচ্ছায় যুদ্ধের মাটিতে সামনের সারিতে ট্যাঙ্কের চালক হিসেবে দাঁড়িয়েছিলেন সেদিন। তবে ভালোবাসার দিনে এসব যুদ্ধ সৈন্যসামন্ত শুনে ভয় পাবেন না যেন। মারিয়ার জীবনকাহিনীতেই লুকিয়ে আছে এক নিঃস্বার্থ ভালোবাসার গল্প।
১৯০৫ সালের ১৬ আগস্ট। ইউক্রেনের দক্ষিণে এবং রাশিয়ার পশ্চিমে অবস্থিত ক্রিমিয়ায় জন্ম নিলেন মারিয়া। নিম্নবিত্তের এক কৃষক পরিবারে দশ ভাই-বোনের সাথেই তাঁর বেড়ে ওঠা। পরিবারের খোরাক জোগাতে করেছেন চাকরীও। সাল ১৯২৫, মারিয়া তখন বিশ বছরের যুবতী। বিয়ে হয় সোভিয়েত আর্মির এক অফিসারের সাথে। এরপর থেকেই যুদ্ধের নেশা যেন তাঁকে টানতে থাকে। তাই সামরিক বাহিনীর সদস্যদের স্ত্রীদের নিয়ে গঠিত কাউন্সিলেও ঢুকে গেলেন অকপটে। সামরিক বাহিনীর নার্সের ট্রেনিং সাথে কিছু আগ্নেয়াস্ত্র ও সাঁজোয়া যান চালানোর কৌশলও রপ্ত করে ফেললেন আগ্রহ বশে।
১৯৩৯ সাল। শুরু হল ধ্বংসলীলার তান্ডব। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামা বেজে উঠছে চারিদিকে। হিংস্রতা, বর্বরতা, নিষ্পেষণের এক আঁতুড়ঘর। রক্তের প্লাবনে ভাসছে ক্ষুধার্ত শরীর সব। ১৯৪১ এ শুরু ‘দ্য প্যাট্রিয়টিক ওয়ার’। চার বছর ধরে চলা এই যুদ্ধে গণহত্যার শিকার লাখো শরীর। মারিয়া তখন সাইবেরিয়ার শহর টম্স্কে। হঠাৎ একদিন খবর এল ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভে যুদ্ধে মারা গেছেন স্বামী। যোগাযোগ ব্যবস্থা খারাপ থাকায় স্বামীর মৃত্যু সংবাদটাও এসে পৌঁছয় দু’বছর পর। তখন তিনি হয়ে উঠলেন এক রুক্ষতার ভাবমূর্তি। মনের আগুনে আহুতি দিলেন সব আবেগ। প্রতিজ্ঞারা তখন মনের কোণায় ভিড় জমিয়েছে। নিজেকে সঁপে দিলেন পাল্টা যুদ্ধের প্রস্তুতিপর্বে। পাঁচ মাসব্যাপী ট্রেনিং। পুরুষদের অবহেলা কটূক্তির তীর যে একেবারেই আসেনি, তাও নয়। কিন্তু সহ্যের একাগ্রতা ছিল উচ্চ পর্যায়ে।
১৯৪৩ সালের ২১ অক্টোবর। মারিয়া শহর স্মলেন্স্কে। শত্রুপক্ষের তুমুল গোলাবর্ষণ অগ্রাহ্য করে সেদিন এগিয়ে যাচ্ছিলো মারিয়ার ট্যাঙ্ক। মেশিনগান এবং অন্যান্য আর্টিলারি গানের জায়গাগুলো একের পর এক ধ্বংস করে এগিয়ে চলেছেন। নিষেধ অমান্য করেই মাঝেমধ্যে বাইরেও আসতেন ট্যাঙ্কের গোলযোগ হলে। যুদ্ধের সামনে ভয়ে একফোঁটাও টলেনি সেদিন তাঁর পা। নিজের গতিতেই এগিয়েছে তাঁর ট্যাঙ্ক, ‘ফাইটিং গার্লফ্রেন্ড’। ফাইটিং গার্লফ্রেন্ড নিয়েই নিশ্চিহ্ন করেছেন বহু জার্মান ঘাঁটি। মনের মধ্যে কোথাও হয়ত স্বামীর মৃত্যুর প্রতিশোধের জ্বালাটা চেপেই রেখেছিলেন তিনি।
কিন্তু এবার যে থামানোর পালা। অ্যান্টি-ট্যাঙ্ক মাইনের আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় ফাইটিং গার্লফ্রেন্ডের ট্যাঙ্ক। কিন্তু তাতেও থামেননি তিনি। গোলাবর্ষণের মাঝেই নির্ভয়ে বেরোলেন ট্যাঙ্ক সারাতে। কাজ প্রায় শেষের মাথায়, ঠিক তখনই আর্টিলারি শেল গেল ফেটে। মাথায় তীব্র চোট পেলেন। সঙ্গে সঙ্গে নিয়ে যাওয়া হল হাসপাতালে। দু’মাস কোমায় থাকার পর ১৯৪৪-এর ১৫ মার্চ সব শেষ। কিছু ভালোবাসা হয়তো এভাবেই গভীরের এক অপ্রকাশিত কাহিনী হয়েই থেকে যায় চিরকালের জন্য। তাই ভালোবাসার প্রসঙ্গ উঠলেই মারিয়ার সেই নিঃস্বার্থ ভালোবাসা ফ্যাসিস্টের সঙ্গে চোখে চোখ রেখে লড়ে যাওয়া শেখায়।
Discussion about this post