ঝিঁঝিঁ পোকা বা আরও ভালোভাবে বলতে গেলে ঝিঁঝিঁ খেলা বিষয়টি বেশ বর্ণময়! কেন জানেন তো? কী অতো সাত পাঁচ ভাবছেন? হঠাৎ ঝিঁঝিঁ নিয়ে পড়লাম কেন? আরে মশাই দোষ কি শুধু আমার একার? স্বয়ং নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় বঙ্গ-ব্রিগেডের জাতীয় যুব-প্রতিনিধি টেনিদার সাগরেদ প্যালারামের মুখ দিয়ে ক্রিকেট মানে তো ঝিঁঝিঁ খেলাই বোঝাতে চেয়েছেন। বাংলা সিনেমার মাধ্যমেও আমরা বুঝেছি বাংলার ক্রিকেট-চরিতকে। তাই বাঙালী অলস ও ইতিহাস বিমুখ; এই বদনাম ঘোচানো যাক। একটু ফিরে তাকাই অতীতের দিকে যেই পরিচিত প্রেক্ষাপটে ফুটবল সর্বদাই জনপ্রিয়তার নিরিখে ফাইনালে ক্রিকেটকে হারিয়ে ট্রফি নিয়ে যেত।
স্বাধীনতার দু’দশক আগে থেকেই মোটামুটি বাংলার নিজস্ব ক্রিকেট যুগের শুরু বলে ধরা হয়। সেই সময়ে বাংলার ক্রিকেট সাম্রাজ্যের রাজসিংহাসনে ছিলেন পুটুঁ চৌধুরী, সুটে ব্যানার্জি, মন্টু ব্যানার্জি, পঙ্কজ রায়, প্রবীর সেন, নির্মল চট্টোপাধ্যায়, কমল ভট্টাচার্য, কার্ত্তিক বসু প্রমুখ। পঙ্কজ রায় ১৯৫৬ সালে নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে ভিনু মানকরের সাথে ওপেনিং জুটিতে ৪১৩ রান করে ঢুকে পড়েন ইতিহাসের পাতায় এবং সেই রেকর্ড আগামী ৫২ বছর অক্ষত ছিল। পরবর্তীকালে প্রবীর সেন বিজয় হাজারের অধিনায়কত্বে অস্ট্রেলিয়া সফরে গিয়ে অনুশীলন ম্যাচে উইকেট-রক্ষক হিসেবে স্যার ডন ব্র্যাডম্যানকে স্ট্যাম্প আউট করে মাত্র শূন্য রানে প্যাভিলিয়নের রাস্তা দেখান।
এখানেই বাঙালী দাপটের শেষ নয়। জাতীয় ফুটবল দলের অধিনায়ক হিসেবে চুনী গোস্বামীর যেমন একাধিক আন্তর্জাতিক কৃতিত্ব রয়েছে তেমনিই ক্রিকেটেও তাঁর পটুতা এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে তাঁকে। তিনি বাংলা দলের অধিনায়কত্বও করেছেন এবং খটখটিয়েছিলেন ভারতের জাতীয় টেস্ট দলে ঢোকার দরজাও। জামশেদপুরে কিনান স্টেডিয়ামে ভারতে আসা সোবার্স, লয়েড, রোহন কানহাই সমৃদ্ধ ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে প্র্যাকটিস ম্যাচে ৬ টি উইকেট নেন। যদি সেক্ষেত্রে এই সুযোগ তিনি পেতেন তাহলে তিনিও ইংল্যান্ডের ডেনিস কম্পটনের মতো একাসনে বসতে পারতেন। খোদ কালিদাসও বোধহয় সাহস পেতেন না এই ধরনের মহাকাব্য লিখতে।
গোপাল বসু, শ্যামসুন্দর মিত্র, পি বি দত্ত, সমীর চক্রবর্তী, প্রনব রায়, শিবশঙ্কর পাল, উৎপল চ্যাটার্জি, রনদেব বসু,……না না, এগুলো কোনও ক্যুইজের ‘কমন ফ্যাক্টর’ খোঁজার প্রশ্ন নয়। বর্তমানে ভারতীয় ক্রিকেটে বাঙ্গালীদের ব্রাত্য করে রাখার ফ্যাশন তখনও ছিল। আর এটাই হল সেই লিস্টি যেটি কালের সীমা পেরিয়ে ২০২১-এ এসে পড়েছে। ১৯৮৮-৮৯ এর রঞ্জি ট্রফিতে ৬ টি সেঞ্চুরির মালিক স্নেহাশিস গাঙ্গুলী ফাইনালে বাদ পড়েন বাংলা দল থেকে। তৎকালীন জাতীয় নির্বাচক রাজ শিং দুঙ্গারপুর এসেছিলেন তাঁর পারফরমেন্স দেখতে। কান পাতলে শোনা যায়, ফাইনালের আগের দিন সিএবি’র রুদ্ধদ্বার বৈঠকে তৎকালীন সিএবি কোষাধ্যক্ষ চণ্ডী গাঙ্গুলির সুপারিশে বাদ পরের তারই বড়ো ছেলে স্নেহাশিস আর দলে জায়গা পান তাঁর ছোট ছেলে আনকোরা সৌরভ গাঙ্গুলী। যদিও রঞ্জি ফাইনালে মোটেও সুবিধা করতে পারেননি আমাদের ‘দাদা’। কিন্তু তারপর খুব বেশিদিন অপেক্ষা করতে হয়নি আমাদের। সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় এবং জগমোহন ডালমিয়ার দৌলতে ক্রিকেট বাংলার আড্ডাঘর থেকে জায়গা করে নিলো হেঁসেলেও।
বাংলার ফার্স্ট ডিভিশনে খেলা এক প্রাক্তন ক্রিকেটার অলোক মিত্রের সাথে কথা প্রসঙ্গে উঠে এলো তখনকার আর এখনকার বাংলা ক্রিকেটের হাল-হকিকৎ। তিনি জানালেন এক টাকা চার আনায় পাওয়া যেতো টেনিস বল, তারপর বেশ কয়েকদিন ব্যাবহারের পর অর্ধ-ন্যাড়া সেই বল দিয়েই পাড়ায় পাড়ায় খেলা হত ক্রিকেট। তখন অবশ্য এখনকার মতো ওভারে খেলা হত না, খেলা হতো ইনিংসে। আর এখনকার মতো ক্রিকেটাররা টাকা পেতেন না, বরং টাকার বদলে শৌখীনতাকেই তারা তাদের মূলধন করে পথ চলেছেন। আর মাঠের দর্শকরাও আলোচনার ঝালে-ঝোলে সমৃদ্ধ হতেন। রঞ্জি ট্রফিতেও কম করে ইডেনে হাজার পাঁচেক দর্শক হয়েই যেতো। আর তখনকার অফিস লিগও যথেষ্ট সাড়া ফেলতো। চাকরি সূত্রে অন্য রাজ্য থেকে আসা ক্রিকেটাররা প্রতিভাবান হলে জায়গা করে নিতেন ফার্স্ট ডিভিশনে বা রাজ্য দলে, যার উদাহরণ হলেন অরুনলাল বা রুশি জিজিবয়। কিন্তু বর্তমানে উত্তরপ্রদেশ, বিহার বা মধ্যপ্রদেশের ক্রিকেটারদের চাপে ক্রমশঃ পিছিয়ে পড়ছে বাঙালীরা।
এবার করছি সেই ক্রিকেট পদাবলীর শুরু, ধ্যেইতা নাচো গুরু। মাল্টিপ্লেক্সীয় সংস্কৃতিভাসী আম জনতা এখন ঠিক আই.পি.এল দেখতে যায়না, যায় ভরপুর বিনোদন দেখতে। উৎকর্ষতার পরশপাথর হারিয়ে গিয়ে টাকা আর পেশাদারিত্বের মোড়কে আমরা দেখতে পাচ্ছি ক্রিকেট প্যাকেজ। তাই সেখানে আর কোনও গুরুত্ব নেই রঞ্জি ট্রফি বা রোহিংটন বারিয়া ট্রফির। তাই রক্ষনশীলতার গণ্ডি ভেঙ্গে অতি-আধুনিক হতে চাওয়া বাঙালীর ক্রিকেট কি খুঁজে পাবে সমুদ্র-মন্থনের অমৃত? নাকি ছিটকে যাবে সাফল্যের টুর্নামেন্টের গ্রুপ লিগ থেকেই সেই প্রশ্নের উত্তরটা বরং ভবিষ্যতের গর্ভেই লুকিয়ে থাকুক।
কভার চিত্র ঋণ – সাত্যকি আচার্য্য
Discussion about this post