“আমরা সিঁড়ি তোমরা আমাদের মাড়িয়ে প্রতিদিন অনেক উঁচুতে উঠে যাও তারপর ফিরেও তাকাও না পিছনের দিকে”
কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের ‘সিঁড়ি’ কবিতাটা মনে আছে নিশ্চয়ই। সমাজের এক নীরস বাস্তবকে টেনে এনে নাড়িয়ে দিয়েছিলেন তথাকথিত শিক্ষিত সমাজকে। প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে আজকের সভ্য সমাজ, রূপের পার্থক্য অনেকটাই। যদিও একটা প্রথা আজও অপরিবর্তিত। তা হল, নিচুতলার মানুষের উপর উপরতলার আবেগহীন হুকুম। আজকের একবিংশ শতাব্দীতেও তার কিন্তু অন্যথা হয়নি। এই মুহূর্তে চারিদিকে রব উঠেছে ‘কৃষক বিদ্রোহ’। কৃষকসমাজ, যাদের সারাবছরের হাড়ভাঙা খাটুনিতে শস্যশ্যামলা হয়েছে এই ভারত। তাদেরই ওপর চলে বরাবরের অবহেলা কিংবা লাঞ্ছনা। তাদের লাভের লোভ দেখিয়ে মুনাফা লোটে উঁচুতলার মানুষ। আর যখন পেটের টানে বাবুদের আসল চালাকিটা ধরে ফেলে, তখনই হয় বিদ্রোহ। আর সেসবের দাগ এখনো লেগে রয়েছে ইতিহাসের পাতায় পাতায়।
ঊনবিংশ শতকের নীল বিদ্রোহের কথা মনে পড়ে? ঊনিশ শতকের প্রথমার্ধ। ইংল্যান্ডে তখন তুমুল শিল্পবিপ্লব। বস্ত্রের জোগানে হিমশিম খাচ্ছে ওখানের বস্ত্রশিল্প। কিন্তু পোশাকের রঙের জন্য প্রয়োজনীয় নীলের উৎপাদনে ছিল ব্যাপক ঘাটতি। তৎক্ষনাৎ মুনাফা লোভী ব্রিটিশ ছক কষে ফেলল। বাংলার উৎকৃষ্ট জমিগুলোতে বেছে বেছে শুরু হল নীলচাষ। বর্ধমান, বাঁকুড়্ বীরভূম, নদীয়া, মুর্শিদাবাদ এবং বর্তমানে বাংলাদেশের অন্তর্গত খুলনা রাজশাহীতে বহু ধানের জমিকে জোর করে করা হল নীলচাষের জমি। বাংলাদেশের প্রায় ২০ লক্ষ বিঘা জমির ১৩ লক্ষ বিঘাতে শুধু নীলচাষই হত। অল্প সুদে অগ্রিম দেওয়া হতো চাষীদের। বিনিময়ে উৎপাদিত নীলের প্রায় সবটাই যেত ইংল্যান্ডে। কোম্পানির লাভও বাড়ল বহু গুণ। এতটাই লাভজনক হল যে, বহু কর্মচারী ও সরকারি আমলারা চাকরি ছেড়ে নীলচাষে ঝুঁকল। বাংলায় সে সময় গড়ে ওঠে ১১৬ টি নীলচাষ কোম্পানি। যার ৬২৮ টি সদর কুঠির অধীনে ৭৪৫২ টি নীলকুঠি। এদের উঁচু দায়িত্বে থাকত শ্বেতাঙ্গরা। বিদেশি মূলধনের শতকরা ৭৩% নীলচাষে লগ্নিকৃত ছিল।
কিন্তু প্রশ্ন হল, এতে চাষীদের অবস্থার কতটা উন্নতি হল? সরকারি হিসেবে দেখা যায়, সারাদেশে নীল উৎপাদন ১০ হাজার ৭৯১ মণ। কিন্তু নীলচাষীরা চাষ করে যে টাকা উপার্জন করত, তাতে তাদের দাদনের টাকাই পরিশোধ হতো না। ১৮৪০ সালে হিলস নামক ইংরেজ নীলের নির্দিষ্ট মূল্য ধার্য করেন। ১০ বান্ডিলের দাম ১ টাকা। এক বিঘায় ৭ বান্ডিল মতো চাষ হয়। অর্থাৎ প্রতি বিঘায় প্রায় ১১ টাকার নীল হয়। কিন্তু এদিকে এক মণ উৎকৃষ্ট নীলের বিক্রয়মূল্য ছিল ২৩০ টাকা। খুব খারাপ নীল হলে এক মণ ১০৯ টাকা। সুতরাং বোঝাই যায়, কৃষকদের উপার্জন ছিল নামমাত্র। তাদের লোকসানের পাল্লাই থাকত বরাবর ভারী। এদিকে চুক্তি অনুযায়ী অন্য কোনও ফসল ফলানোর অধিকারও তাদের ছিল না। চুক্তি না মানা হলে চলত কুঠিয়ালদের অকথ্য অত্যাচার। বহুদিনের অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে ফেটে পড়ে নীলচাষীরা। কিন্তু কোম্পানি ১৮৩০ এ আরেকটি আইন জারি করলেন। চুক্তি না মানলে ফৌজদারি মামলা চাপানো হবে নীলচাষীর উপর। মধ্যবিত্ত সম্প্রদায় যদিও এগিয়ে আসে কৃষকদের পাশে, চলে আন্দোলন। ইতিহাসের পাতায় আজও জ্বলজ্বল করে সেই ‘নীলবিদ্রোহ’।
আজও যেন সেই একই পরিস্থিতির পুনরুত্থান। সাম্প্রতিক কালে লোকসভায় একটি কৃষি বিল পাশ হয়েছে। যেখানে ফসলের ‘নূন্যতম সহায়ক মূল্য'(এমএসপি) লঘু করার চেষ্টা চলছে। ‘নূন্যতম সহায়ক মূল্য’ হল প্রতি ফসলের একটি সরকারি ধার্যমূল্য। এতে কৃষকরা তাদের উৎপাদিত ফসল থেকে একটি নূন্যতম মূল্য পেত। ‘কিষান মান্ডি’তে কোনো কারণে কৃষকের ফসল না বিক্রি হলে, সরকার ঐ নূন্যতম সহায়ক মূল্যতে ফসলটি কিনত। এতে কৃষকদের পছন্দের ফসল ফলানোর অধিকারও ছিল। কিন্তু নতুন কৃষিবিলে কৃষকের সেই আশা খর্ব হওয়ার আশঙ্কা বাড়ছে। বদলে কোম্পানির আগাম টাকায় চাষের চুক্তি অর্থাৎ ‘কন্ট্রাক্ট ফার্মিং’ এর উপর জোর দেওয়া হচ্ছে। এককথায় বলতে গেলে, কৃষিকে কর্পোরেটের আওতায় আনার একরকম প্রচেষ্টা করছে সরকার। যেখানে কোম্পানি সরাসরি কৃষকদের সাথে চুক্তিবদ্ধ হবে। তাতে কৃষকদের দুশ্চিন্তা এটাই, তারা না বোঝে রাজনীতির মারপ্যাঁচ আর না বোঝে কোম্পানির মুনাফা-নীতি। সারাবছরের রোদ-জলের পরিশ্রমের উপযুক্ত পারিশ্রমিক কি তারা আদৌ পাবে? বড় বড় কোম্পানির হাতে থাকে আইন, থাকে বড় বড় কৃষিবিজ্ঞানী। তাই কৃষকদের ঠকিয়ে যথাযথ মূল্য না দিয়ে ফসল অধিগ্রহণ কোম্পানির কাছে জলভাত। পাঞ্জাব-হরিয়ানার কৃষকরা তাই প্রথম এই আইনের তীব্র প্রতিবাদে এগিয়ে আসে। মাইলের পর মাইল হেঁটে চলে মিছিলে। দিল্লির রাজপথে বসে ধর্নায়। সাধারণ মানুষও কৃষকদের সমর্থনে দিকে দিকে গর্জে উঠেছে। সবার দাবি, অন্ততঃ কৃষিকে কর্পোরেটের আওতা থেকে মুক্ত রাখা হোক।
Discussion about this post