কলকাতা ছাড়লেই দামোদরের পূর্ব তীরে ছবির মতো জনপদ আমতা। কলকাতার মতোই এই শহরের পত্তনের কোনও ইতিহাস নেই। খালি উদরে আছে ছোটো কলকাতা নামে গ্রাম। আর সেখানে আছে কালীমন্দির, ধর্মতলা, কালীতলার মতো পাড়া। তবে নানা ঐতিহ্যে পুষ্ট এবং একই সঙ্গে জর্জরিত সমস্যার জাঁতাকলে। তাই ঐতিহ্যের সুখ-স্বপ্নে ডুব দিয়ে শুধু বিভোর হয়ে থাকা নয়, নানা সমস্যা থেকে খুশির আশায় এই শহরের মানুষ। হাওড়া জেলা জুড়ে যে বিশাল গ্রামীণ এলাকা রয়েছে, তার মধ্যে ইংরেজদের সময় থেকেই আমতাকে একমাত্র শহরে বলে গণ্য করা হত। আজকের মতো বাস, ট্রেকার, অটো, টোটো কিছুই তখন ছিল না| কয়লায় চলত এই ট্রেন| ছোট্ট ইঞ্জিন আর সাত আটটা ছোটো ছোটো কামরা নিয়ে দুলকি চালে রওনা দিত মার্টিন ট্রেন। হাওড়া হুগলির প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলের মানুষের মনে এক অদ্ভুত আনন্দের জোয়ার এনে দিয়েছিল এই ট্রেন।
১২ জুন ১৮৮৯ সালে হাওড়া জেলা বোর্ড এবং মেসার্সের মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। বেঙ্গল জেলা রোড ট্রামওয়েজ কোম্পানির পক্ষে ওয়ালশ, লাভট্ট অ্যান্ড কোম্পানী; এটি কোম্পানিকে রাস্তার একটি অংশে ট্রামওয়ে নির্মাণ এবং কাজ করার অধিকার দেয়। পরবর্তীকালে এটি মার্টিনের লাইট রেলওয়ে কো লিমিটেড দ্বারা পুনর্নবীকরণ করা হয় এবং ২৭ মার্চ, ১৮৯৫-এর কলকাতা গেজেটে সরকারী বিজ্ঞপ্তি দ্বারা অনুমোদিত হয়। ১৮৯৫ সালের ২ মে ‘হাওড়া-আমতা লাইট রেলওয়ে সংস্থা’ গঠন করেছিল এবং মার্টিনের লাইট রেলওয়ে (এমএলআর) কাজ করেছিল। এমএলআর ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, বিহার এবং উত্তরপ্রদেশ রাজ্যের সাতটি ন্যারো-গেজ রেলপথ নিয়ে গঠিত।
যদিও কোথাও কোনো ষ্টেশনেই প্ল্যাটফর্ম ছিল না, সেই সময় গুরুত্বপূর্ণ স্টেশন ছাড়া ট্রেনেরই কোথাও প্ল্যাটফর্ম থাকত না তো এমন ধীরে চলা গাড়ীর প্ল্যাটফর্ম আশা করাও ঠিক নয়. যদিও মাটি থেকে খুব সহজেই তিন ধাপ পাদানি পেরিয়ে ঢুকে পড়া যেত কামরার ভেতর আবার সেই পথেই নেমে আসা যেত। এই ট্রেনের যাত্রাপথে যে স্টেশনগুলি পড়ত সেগুলি হল- হাওড়া ময়দান, বালটিকুরী,, বাঁকড়া, সলপ, কাটলিয়া, মাকড়দহ, ডোমজুড়, দক্ষিণবাড়ি, বড়্গাছিয়া, পাতিহাল, মুন্সিরহাট, মাজু, দক্ষিণ মাজু, জালালসী, পানপুর, হরিশদাসপুর ও আমতা। হাওড়া ময়দান থেকে আমতার মধ্যে ছোটো লাইনের পরিচিত মার্টিন রেল শুধু আমতা নয়, আপামর হাওড়াবাসীর কাছে এই ট্রেন ছিল আপনজনের মতো। কারও বাড়ির উঠোন, কারওর বাগানের ভিতর দিয়ে ইঞ্জিনের কালো ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে এগিয়ে যেত সেই রেলগাড়ি। মজার এই রেলগাড়ি নিয়ে অনেক গল্প আছে।
‘নতুন পাতা’ (দীনেন গুপ্ত), ‘ধন্যি মেয়ে’ (অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়) প্রভৃতি অনেক ছবির শুটিং এই ট্রেনে হয়েছিল। আমতার প্রত্যন্ত গ্রামে তৈরি মাদুর দু’টি কামরা বোঝাই করে কলকাতায় আসত। দাশনগর যে শেফিল্ড আখ্যা পেয়েছিল তার প্রধান সূত্র আমতা ও মার্টিন রেল। শনিবার বাড়ি গিয়ে আবার সোমবার সব কাজের লোকে জায়গায় ফিরত। লোকে টিকিট কম কাটত তাই কোম্পানি ভেন্ডার গাড়ি বেশি দিত। এই ট্রেনটি প্রত্যন্ত গ্রামের মানুষের প্রধান সহায়ক ছিল। স্টেশনগুলির নাম আজ হারিয়ে গেছে। এর প্রধান কারন ছিল রানীহাটি হয়ে হাওড়া-আমতা সড়কটি তৈরি হবার পর মার্টিন ট্রেনের গুরুত্ব ক্রমশ কমতে থাকে।
ধীর গতিতে চলা মার্টিন ট্রেনে গন্তব্যে পৌঁছতে সময়ও লাগত অনেক। এরই সঙ্গে টিকিট না কেটেই বহু মানুষ উঠে পড়ত ট্রেনে। তাই অনেক যাত্রী পরিবহন করেও লোকসানের মুখে পড়তে থাকে মার্টিন কোম্পানি। অনেক সম্ভাবনা ও সুযোগ থাকা সত্ত্বেও মাত্র ৭২ বছরেই ইতি ঘটে গেল এই স্বপ্নের পরিবহণটির। তাছাড়া স্বাধীনতার পর সরকারী তরফেও কোনও আগ্রহ ছিল না এই ঐতিহাসিক ট্রেনটিকে চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার। তাই বাধ্য হয়ে ১৯৭০ সালে চিরতরে স্তব্ধ হয়ে গেল ট্রেনটির চাকা। এভাবেই হাওড়া-আমতা রেলপথে ছোটো ছোটো কামরা নিয়ে কয়লার ধোঁয়া উড়িয়ে হুইসেল বাজিয়ে ছুটে চলা মার্টিন ট্রেন চলে গেল ইতিহাসের পাতায়।
Discussion about this post