বাংলা চলচ্চিত্র জগতের কৌতুক সম্রাট ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়কে কে না চেনে! উৎসাহী হয়ত এও জানে তাঁর আসল নাম ছিল সাম্যময় বন্দ্যোপাধ্যায়। লোকমুখে শোনা যায় তাঁর দাদু অথবা বাবা রেখেছিলেন এই নাম। তবে এ কথা ক’জন জানেন যে যৌবনে তিনি ছিলেন পুরোদস্তুর এক স্বাধীনতা সংগ্রামী! এমনকি একসময় পাচার করেছিলেন রিভলভারও। পরবর্তীকালে সেই তিনিই হয়ে উঠেছিলেন চলচ্চিত্রের অন্যতম শ্রেষ্ঠ এক কৌতুকাভিনেতা। কীভাবে? আসুন জেনে নিই সেই কাহিনীই।
জন্ম ১৯২০ সালে ওপার বাংলার বিক্রমপুরে। বিদ্যালয়ের পাঠ চুকিয়ে তিনি ভর্তি হলেন ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয়ে। সেখানে তখন নামী সব অধ্যাপকের আসর৷ ধীরে ধীরে বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসুর প্রিয়পাত্র হয়ে উঠলেন তিনি। তবে স্বাধীনতা আন্দোলনে হাতে খড়িটা সেই কৌশোর থেকেই শুরু। মাত্র ১২ বছর বয়সেই জড়িয়ে পড়লেন বৈপ্লবিক কর্মকান্ডে। বিপ্লবী দীনেশ গুপ্তই ছিলেন তাঁর অনুপ্রেরণা। সংগ্রামের প্রথম পাঠ যে তাঁর কাছেই পাওয়া। গোপনে বিপ্লবী বই, প্রচারপত্র পাচার করাই ছিল ভানুর কাজ। এমনকি এক জায়গা থেকে অন্য এক জায়গায় রিভলভার পৌঁছনোরও কাজ করেছেন তিনি। ব্রিটিশদের হাতে দীনেশ গুপ্তের মৃত্যুর পর তিনি যোগ দেন ঢাকার অনুশীলন সমিতিতে৷ সেখানে থাকাকালীনই পুলিশের নজরে পড়েন। অনুশীলন দলের একাংশে উদ্যোগে তৈরি হল বামপন্থী আরএসপি দল। ভারত ছাড়ো আন্দোলনে তখন অংশগ্রহণ করল সেই দল, সেই সঙ্গে যুক্ত হলেন ভানুও। তবে পুলিশের খাতায় নাম থাকলেও গ্রেফতারির হাত থেকে বেঁচে গিয়েছিলেন তিনি।
তাঁর নামে হুলিয়া জারি হলে ভানু তখন চলে আসেন কলকাতায়। কলকাতায় এসেই প্রথমে তিনি চাকরি নিলেন আয়রন এন্ড স্টিল কোম্পানিতে। আর নেশা বলতে তখন একটাই, ‘ইস্টবেঙ্গল’। খেলা থাকলে গ্যালারিতে তখন ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় থাকবেনই। ক্লাবের কর্মকর্তা জ্যোতিষ চন্দ্র গুহর বেশ কাছের মানুষই হয়ে ওঠেন তিনি। এমনকি একসময় ক্লাবের ভেতরের রাজনীতিতেও জড়িয়ে ফেলেছিলেন নিজেকে। পাঁচের দশক পর্যন্ত ইস্টবেঙ্গলের সঙ্গে গভীর যোগাযোগ ছিল ভানুর। এরপর ১৯৪৬ সালে অভিনয় শিল্পী হিসাবে প্রথম আত্মপ্রকাশ। চন্দ্রগুপ্ত নাটকে চাণক্যের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন তিনি। এরপর ধীরে ধীরে চলচ্চিত্র জগতে প্রবেশ। ১৯৫৩ সালে মুক্তি পাওয়া ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ ছবি দিয়েই নিজের জায়গা পাকা করে ফেলেন ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়।
নিজের অভিনয় জীবনেও কখনও অন্যায়ের সঙ্গে একফোঁটা আপস করেননি তিনি। কলাকুশলীদের সংগঠনই হোক বা বিভিন্ন ধর্মঘট, সবার আগে বিশেষ তৎপর হয়েছেন তিনিই৷ এই কারণে খ্যাতির শীর্ষে থাকাকালীনই একসময় টানা কিছু বছর তাঁকে নিজের কাজ পাওয়া থেকে বঞ্চিত করা হয়। সেসময় তিনি জলসা, থিয়েটার বা বিভিন্ন কৌতুক অভিনয়েই মন দিয়েছিলেন। তবে কিছুতেই হাল ছাড়েননি। দীনেশ গুপ্তর শিষ্য ছিলেন বলে কথা! আপস করা যে কখনোই শেখেননি তিনি। শত কষ্টের মধ্যেও মুখ থেকে হাসিটি মোছেনি তাঁর। তাই আজও মনের মণিকোঠায় উজ্জ্বল এক নক্ষত্রের মতই তাঁর স্থান। সেই হাস্য-কৌতুকের মোহে আজও নিজেদের জড়িয়ে রেখেছে আপামর বাঙালি।
চিত্র ঋণ – ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় ফেসবুক পেজ থেকে পাওয়া
Discussion about this post