তিনি এক করোনা-যোদ্ধা। নিজের স্বাস্থ্যের চিন্তা জলাঞ্জলি দিয়েই করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধে নিজেকে এতদিন সামিল করেছিলেন। এবার তারই এল পজিটিভ রিপোর্ট। জীবিকাসূত্রে তিনি কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের স্কুল অফ ট্রপিকাল মেডিসিনের এক স্বাস্থ্যকর্মী। তাঁর নাম তনুশ্রী ভট্টাচার্য। গত সপ্তাহে তাঁর করোনার পরীক্ষার রিপোর্ট আসে পজিটিভ। সঙ্কটজনক অবস্থা না থাকায় চলতি সপ্তাহের মঙ্গলবার থেকে আগামী ১৪ দিন তাঁকে কোয়ারেন্টাইনে থাকার পরামর্শ দেয় স্বাস্থ্য দফতর। কিন্তু তাঁর বাড়িতে আলাদাভাবে থাকার সুবিধা নেই। তাছাড়া রাতে হঠাৎ কোনো সমস্যায় পড়তে হতে পারে, সেই উদ্বেগ থেকেই তিনি মেডিক্যাল কলেজেই করোনা চিকিৎসার বিভাগে ভর্তি হয়ে যান তিনি। এই অবধি পরিস্থিতি ছিল বেশ স্বাভাবিকই। কিন্তু এরপরই গল্পটা বদলে যায়।
তনুশ্রী দেবীর পৈতৃক বাড়ি হুগলির শ্রীরামপুরের মাহেশে। সেই বাড়িতে তাঁর প্রায় ৯০ বছরের মা এবং আরও তিন দিদির সঙ্গেই থাকতেন তিনি। করোনা পজিটিভ আসার পরই নিজের দিদি এবং মায়ের থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে নেন তিনি। ঠিক এই পরিস্থিতিতে ওই পাড়ারই কিছু ব্যক্তি হুগলি জেলার সমস্ত করোনা আক্রান্তদের নাম, ঠিকানা, ফোন নম্বরসহ সমস্ত তথ্য জোগাড় করে হোয়াটসঅ্যাপে ছড়িয়ে দিতে শুরু করেন। সেই তালিকায় তনুশ্রী দেবীর নাম থাকার ফলে তাঁদের বাড়িটিকেই নিশানা করে পাড়ার মানুষ। বাড়িটিতে কোনও খাদ্যদ্রব্য বা ওষুধও সরবরাহ করতে দিচ্ছিলেন না তাঁরা। অনলাইনে ওষুধ বা খাবার অর্ডার দিলেও পাড়াতে কাউকে ঢুকতে দেওয়া হবে না বলেও হুমকি দেওয়া হয়েছে। কানাঘুষো এও শোনা যাচ্ছিল যে তনুশ্রী দেবী হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে বাড়ি ফিরে এলেও তাঁকে নাকি পাড়াতে ঢুকতেই দেওয়া হবে না। এমনকি পাড়ার কিছু লোক বাড়ির বন্ধ দরজা-জানলার বাইরে ‘করোনা-করোনা’ বলে চিৎকার ও হাসাহাসিও করছিলেন।
পরিস্থিতির এমন শিকার হয়ে এখন মানসিকভাবে বেশ আঘাতই পেয়েছিলেন তনুশ্রী দেবীর পরিবার। প্রচণ্ড উদ্বেগ এবং আশঙ্কাতেই এখন দিন কাটছিল তাঁদের। তবে স্বস্তির খবর এই যে, মোহিত রণদীপ, সঞ্চারী গোস্বামী, গৌতম সরকার সহ সমাজকর্মী এবং বিভিন্ন গণমাধ্যম কর্মীর উদ্যোগে স্থানীয় পুলিশ এবং কাউন্সিলর হস্তক্ষেপ করেছেন। তাঁদের সকলের সহায়তায় আপাততঃ আশ্বস্ত তনুশ্রী দেবীর পরিবার। মোহিতবাবু প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র তাঁদের বাড়িতে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করেছেন। এমনকি স্বয়ং এসডিও তৎপর হয়ে বিভিন্ন খাদ্যদ্রব্য ও চিকিৎসা সরঞ্জাম নিয়ে তনুশ্রী দেবীর পরিবারের সঙ্গে নিজে যোগাযোগ করেছেন। তিনি এও জানিয়েছেন কারোর কোনো উপসর্গ দেখা দিলেও যেন এরপর ওঁর সঙ্গেই যোগাযোগ করা হয়। পরিস্থিতি এখন বেশ স্থিতিশীল হলেও কিন্তু এখনও রয়েছে বহু প্রশ্ন। এখনও ঠিক কি সমাজে আজ বাস করছি আমরা? যিনি নিজের ও পরিবারের স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে করোনার যুদ্ধে সামিল হয়েছিলেন তাঁকেই হতে হয়েছিল হেনস্থার শিকার? পুলিশ বা প্রশাসন এখন সমস্ত রকম সহায়তা করেছেন ঠিকই। তবে স্থানীয় সমাজসেবীদের হস্তক্ষেপেই এগিয়ে আসেন তাঁরা। কেউ আক্রান্ত হলে পাড়া-প্রতিবেশীর কাছে এখনও এভাবেই কি তাঁদের অপমানিত হয়ে যেতে হবে দিনের পর দিন? ঠিক যতক্ষণ না হস্তক্ষেপ করে প্রশাসন? কে জানে। উত্তর পাওয়া আজ বড়ই কঠিন।
Discussion about this post