পাঁজি বা পঞ্জিকা! শহর হোক বা গ্রাম, মানুষের জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছে এই পাঁজির নাম। সেই প্রাচীন কাল থেকেই পঞ্জিকার প্রভাব বিস্তার করে রয়েছে আমাদের রোজকার জীবনযাত্রায়। বিশেষ করে বাঙালির পয়লা বৈশাখের উৎসব যাপনের একান্ত সঙ্গীই তো এই পঞ্জিকা। পঞ্জিকা একটি সংস্কৃত শব্দ। এর ইংরাজি নাম অ্যালামনাক। বার, তিথি, যোগ, নক্ষত্র ও করন, এই পাঁচটি বিষয়কেই আমাদের কাছে সহজভাবে হাজির করে পাঁজি। এছাড়াও ক্ষণ, লগ্ন, পালা-পার্বন বা রোজকার রাশিফল, এসবেও বাঙালির ভরসা এই পাঁজিই। ঠিক কবে থেকে যে পঞ্জিকা বাঙালির রোজকার প্রয়োজনীয় এক বস্তু হয়ে উঠল তা হিসেব করে বলা না গেলেও, অনুমান করা যায় অষ্টাদশ শতাব্দীর পর থেকেই এর প্রচলন শুরু হয় বেশি।
পঞ্জিকার প্রচলন নিয়েও চালু রয়েছে বেশ কিছু গল্প৷ শোনা যায়, আগেকার দিনে শুভক্ষণ জানার জন্য ব্রাহ্মণ পণ্ডিতদের দারস্থ হতেন সাধারণ মানুষ। কিন্তু এক পণ্ডিতের সঙ্গে অন্য পণ্ডিতের হিসাবে মিল প্রায় থাকতই না বলা চলে। ফলে শুরু হয় গন্ডগোল। ঠিক এই সময়ই কৃষ্ণনগর নিবাসী রঘুনন্দন নামক জনৈক ব্যক্তি সমস্ত বিধিনিষেধ প্রবর্তন করে, নিজে হাতে তা লিখে পুঁথির আকারে প্রকাশ করেন। এইভাবেই সর্বপ্রথম পঞ্জিকার দেখা মেলে। তবে সেই পঞ্জিকাতেও নানা ভুলচুক থেকেই গেছিল। সেই সমস্যা মেটাতেই নবদ্বীপের মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র নদীয়া শ্রেষ্ঠ পণ্ডিত রামচন্দ্র বিদ্যানিধির দারস্থ হন। তিনি তখন পঞ্জিকার এই সংশোধিত সংস্করণ তৈরি করেন। তারপর থেকে সেই পঞ্জিকাই প্রচারিত হতে থাকে। সম্পূর্ণ হাতে লেখা সেই পঞ্জিকার দাম ছিল তখন দুই আনা। তবে সবার পক্ষে তখনও তা কিনে ব্যবহার করা সম্ভব ছিল না। উনিশ শতকের দ্বিতীয় দশকে মুদ্রিত আকারে এটি প্রকাশিত হওয়ার পর সাধারণের কাছে এর সমাদর বাড়ে।
তবে বাংলায় মুদ্রিত প্রথম পঞ্জিকা হিসাবে ১৮১৮ সালে প্রকাশিত রামহরি পঞ্জিকা কেই ধরা হয়। দুর্গাদাস বিদ্যাভূষণ ছিলেন এর প্রকাশক। মূলতঃ ব্যবসায়িক লাভের আশাতেই পঞ্জিকাটি প্রকাশ করেছিলেন তিনি। পঞ্জিকাটি অচিরেই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। ঠিক তার পরের বছরই একই প্রকাশকের আরেকটি পঞ্জিকা বের হয়। সেটিও বেশ রমরমা ব্যবসা করে। ব্যাস, বাংলার প্রকাশনাতে পঞ্জিকা প্রকাশের জোয়ার ওঠে। প্রায় সকল প্রকাশনাই তখন পঞ্জিকা প্রকাশ করতে এবং বিক্রি করতে উঠে পড়ে লেগে পড়ে। বছরের পর বছর বাড়তে থাকে পঞ্জিকার প্রকাশ। কলকাতার বটতলা এবং তার আশেপাশের অঞ্চল পঞ্জিকা প্রকাশের খনি হয়ে ওঠে। বাংলা ইতিহাসে সাড়া জাগানো এমনই কিছু পঞ্জিকা হল- গুপ্তপ্রেস পঞ্জিকা, বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত পঞ্জিকা, মদনগুপ্তের ফুল পঞ্জিকা, বেণীমাধব শীলের ফুল পঞ্জিকা ইত্যাদি। তবে শুরুর দিকে দোকান থেকে কিনতে পাওয়া যেত না এই পঞ্জিকা। উনিশ শতকের গোড়ার দিকে বাংলা বই বিক্রির কোনও দোকান না থাকায় সরাসরি ছাপাখানা থেকেই সংগ্রহ করতে হত এটি। এছাড়াও মুটেরা ঝাঁকায় করে বাড়ি বাড়ি গিয়ে অন্যান্য বইয়ের সঙ্গে পঞ্জিকাও বিক্রি করে আসত। শোনা যায়, ১৮৫৭ সালে কলকাতায় নাকি প্রায় দেড় লাখের কাছাকাছি বিক্রি হয়েছিল এই পঞ্জিকা। সেই সময় অন্য কোনও বইয়ের বিক্রি এত বেশি ছিল না। পঞ্জিকার জন্য প্রকাশনা সংস্থা গুলি ব্যাপক লাভও করতে শুরু করেছিল। ঠিক এমনটাই এর মহিমা!
এখন বর্তমান যুগে শহুরে জীবনে পঞ্জিকা ব্যবহার কমে এলেও, গ্রামের দিকে এখনও বহুল প্রচলিত এই পঞ্জিকা। গ্রামের প্রতিটি মানুষের দিন এখনও শুরুই হয় পঞ্জিকার পাতা উলটে। বাড়িতে অন্যান্য বই থাকুক না থাকুক, বছরের শুরুতে গোলাপি রংয়ের এই বইটি বাড়িতে আনা চাই-ই। তবে শহুরে জীবনযাত্রাতেও যদিও খুব বেশি পিছিয়ে নেই এর চাহিদা। পুজো-আচ্চা হোক বা কোনও শুভ কর্ম, পঞ্জিকার সাহায্য ছাড়া সবই বৃথা! আজকাল হাতের মোবাইলেও পঞ্জিকার ই-সংস্করণ রেখে দিচ্ছে জেন-ওয়াই। কি জানি কখন কি কাজে লাগে! সকালে ঘুম থেকে ওঠা থেকে শুরু করে রাতে ঘুমোতে যাওয়া অবধি, এখনও প্রতিটি পদেই আমাদের সর্বক্ষণের সঙ্গী হিসাবে জড়িয়ে রয়েছে গোলাপি কাগজের মলাটের সাদা-কালো অক্ষরে ছাপা বইটি, যার নাম পঞ্জিকা।
Discussion about this post