বাংলা চলচ্চিত্র জগতে হাসির রাজা বললে যাঁর নাম সবার আগে মনে আসে, তিনি ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু অগণিত মানুষের কাছে তিনি কেবল একজন অভিনেতা ছিলেন না, ছিলেন বিপদের বন্ধু বা ‘মুশকিল আসান’। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় থেকে শুরু করে গীতা দে-র মতো গুণীজনদের স্মৃতিচারণায় উঠে এসেছে ভানুর অভিনয় দক্ষতা এবং তাঁর বিশাল হৃদয়ের নানা অজানা কাহিনী।
প্রয়াত কিংবদন্তি অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়কে দেখতেন এক অনন্য উচ্চতায়। তাঁর মতে, উত্তম কুমার যেমন বাংলা সিনেমার একটি স্থায়ী প্রতীক, ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ও ঠিক তাই। সৌমিত্রর বিশ্লেষণে, সমসাময়িক জহর রায়ের অসামান্য প্রতিভা থাকলেও তাঁর অভিনয়ে মাঝে মাঝে ‘অতি-অভিনয়ের’ প্রবণতা দেখা যেত। কিন্তু ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভিনয় শৈলী ছিল মেদহীন এবং অত্যন্ত সংযত। কমেডিয়ান হিসেবে পরিচিত হলেও তাঁর অভিনয়ের গভীরতা ছিল প্রশ্নাতীত।
তবে, পর্দার বাইরে ভানু ছিলেন এক বিশাল হৃদয়ের মানুষ। সহকর্মী গীতা দে স্মৃতির পাতা উল্টে জানিয়েছেন, কীভাবে নিঃশব্দে মানুষের উপকার করতেন ভানু। কারও বাড়ি ভাড়া দেওয়ার ক্ষমতা নেই, কেউ অর্থাভাবে পরীক্ষা দিতে পারছেন না, আবার কারও চিকিৎসার টাকা নেই— খবর ভানুর কানে পৌঁছানো মাত্রই তিনি ঝাঁপিয়ে পড়তেন। একবার এক শিল্পী বিএ পরীক্ষা দেবেন কিন্তু সামর্থ্য নেই; ভানু শুধু তাঁর পরীক্ষার ফি-ই দেননি, বরং বইপত্রের সমস্ত ব্যবস্থাও করে দিয়েছিলেন। নিজের এই দানধ্যান নিয়ে তিনি কখনও আত্মপ্রচার করেননি।
ভানুর মমত্ববোধের অন্যতম নিদর্শন অভিনেতা শমিত ভঞ্জ। ‘হাটে বাজারে’ ছবির শ্যুটিং চলাকালীন শমিত ছিলেন নবাগত। পারিবারিক কলহে ঘরছাড়া নিরাশ্রয় শমিতকে ভানু নিজের বাড়িতে আশ্রয় দেন। দীর্ঘ দেড় বছর শমিত তাঁর কাছেই ছিলেন। অসুস্থ শমিতের নিজের হাতে সেবা করা থেকে শুরু করে তাঁকে স্টুডিও পাড়ায় পরিচিত করে দেওয়া— সবটাই করেছিলেন ভানু। পরবর্তীকালে ক্যানসারের সঙ্গে লড়াই করার সময়ও শমিত কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করতেন তাঁর প্রিয় ‘ভানু দা’-র কথা।
চলচ্চিত্রের ইতিহাসে নিজের নামে সিনেমার নামকরণ হওয়ার নজির খুব কম। ‘যমালয়ে জীবন্ত মানুষ’-এর আকাশছোঁয়া সাফল্যের পর যখন পরিচালক কনক মুখোপাধ্যায় ‘ভানু পেল লটারি’ ছবির প্রস্তাব আনেন, তখন ভানু নিজেও অবাক হয়েছিলেন। তাঁর সাবলীল অভিনয় এবং জনপ্রিয়তাই এই নামকরণ সার্থক করেছিল। এছাড়াও ‘পার্সোনাল অ্যাসিস্ট্যান্ট’ ছবিতে তাঁর বিপরীতেই রুমা গুহঠাকুরতা প্রথমবার বাংলা সিনেমায় অভিনয় করেন। আধুনিক চিত্র সমালোচকদের মতে, ভানু কেবল একজন কৌতুক অভিনেতা ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন পূর্ণাঙ্গ শিল্পী। আজ যান্ত্রিকতার যুগেও যখন মানুষের মন ভারাক্রান্ত হয়, তখন ভানুর অভিনয় ও তাঁর দরাজ হাসি হয়ে ওঠে পরম শান্তির আশ্রয়।






































Discussion about this post