পুজো শেষ। মণ্ডপগুলো খালি হয়ে গেছে। ঢাকার শাঁখারীবাজার আর তাঁতীবাজারের কুমোরটুলির গলিগুলোতে এখন অদ্ভুত এক গভীর নীরবতা। কদিন আগেও যেখানে ছিল প্রতিমা নেওয়ার ভিড়, মানুষের কোলাহল, আজ সেখানে কেবল ভাঙা কাঠামোর স্তূপ আর শুকিয়ে যাওয়া মাটির গন্ধ। যে গলিগুলোয় রাতদিন খাটুনি চলত, সেগুলো এখন জনশূন্য। যে হাতগুলোয় কদিন আগেও জন্ম নিচ্ছিল মৃন্ময় রূপ, সেই হাতগুলোই আজ অলস বসে আছে। ঢাকের শব্দ আর আরতির ধোঁয়া বাতাসে মিলিয়ে যেতেই যেন এই শিল্পীদের কদর ফুরিয়ে যায়। বছরের বাকিটা সময় তাদের খোঁজ আর কেউ রাখে না। এই নীরবতা তাঁদের জীবনের এক নির্মম সত্য।
এই এলাকার প্রবীণ শিল্পীদের অনেকের মুখেই এখন হতাশার ছাপ। চল্লিশ বছর ধরে এই কাজ করছেন, এমন একজন শিল্পী বলছিলেন, প্রতি বছর কাঁচামালের দাম বাড়ছে। মাটি, খড়, রঙের যে দাম, প্রতিমা বেঁচে সেই টাকা উঠেই আসে না। তার উপর পুজোর কমিটিগুলো দাম বেঁধে দেয়। শিল্পীরা বলছেন, ‘আমরা দরাদরি করার সুযোগ পাই না।’ অনেকে টিকে থাকার জন্য পূজার আগেই ‘দাদন’ বা অগ্রিম টাকা নিতে বাধ্য হন। সেই টাকা শোধ নিতে গিয়ে লাভের অংশ বলে আর কিছুই হাতে থাকে না। তাদের কথায় স্পষ্ট ক্ষোভ, ‘আমাদের দাম তো ওই পুজোর ক’টা দিন। কাজ শেষ, পয়সা শেষ, সম্মানও শেষ।’
এই পেশার ভবিষ্যৎ কী? কুমোরপাড়ার নতুন প্রজন্ম কি এই ঐতিহ্য আদৌ ধরে রাখতে চায়? উত্তরটা ‘না’-এর দিকেই ভারী। অনেক শিল্পীই জানালেন, তাদের সন্তানেরা এই কাজে আসতে চায় না। তারা দেখেছে এই পেশায় কত কষ্ট আর কত অভাব। একজন শিল্পী জানালেন, ‘ছেলেকে কষ্ট করে লেখাপড়া শেখাচ্ছি। সে এখন একটা অফিসে ছোটখাটো কাজ করে।’ কারণটা খুবই স্পষ্ট। এই কাজে এখন আর সামাজিক সম্মান নেই, নেই কোনো আর্থিক নিরাপত্তা। পুজোর পর মাসজুড়ে কোনো কাজ থাকে না। তখন কী খাবে? সেই চিন্তা করতে হয়। অনেকে তো পেশা ছেড়েই দিয়েছে। কেউ রিকশা চালায়, কেউ দিনমজুরি করে।
উৎসবের আলো নিভে গেলেই এই মানুষগুলোর জীবনে অন্ধকার নেমে আসে। তারা যেন কেবল আমাদের বাৎসরিক ধর্মীয় প্রয়োজনের একটা অংশ। প্রয়োজন ফুরোলেই তাদের অস্তিত্ব আমরা অনায়াসে ভুলে যাই। এটা শুধু একটা শিল্পের সংকট নয়, এটা একটা আস্ত সম্প্রদায়ের নীরবে হারিয়ে যাওয়ার আভাস। ঢাকার এই মৃন্ময় রূপকাররা যদি একে একে পেশা ছাড়তে বাধ্য হন, তবে এই শৈল্পিক ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রাখবে কে? এই মাটির কারিগরদের জীবনের এই নীরব হাহাকার কি আমাদের কান পর্যন্ত পৌঁছায়? এই কুমারটুলিগুলোর নীরবতা ভাঙার দায়িত্ব আসলে কার?






































Discussion about this post