কার্তিক মাসের শুক্লাপ্রতিপদ। হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের এক বিশেষ দিন—‘অন্নকূট উৎসব’। ‘অন্ন’ অর্থ ভাত, আর ‘কূট’ মানে পর্বত। এই দিনে শ্রীকৃষ্ণের সামনে সাজানো হয় নানা রকম ভোগ—অন্নের পাহাড় গড়ে ওঠে যেন দেবতার আরাধনায়। পৌরাণিক কাহিনি বলে, কার্তিক অমাবস্যার মহাপ্রলয়ের রাতে ব্রজবাসীদের রক্ষা করেছিলেন ভগবান শ্রীকৃষ্ণ। বিপদ কেটে গেলে কৃতজ্ঞতা প্রকাশে ব্রজবাসীরা রাঁধেন অসংখ্য পদ, নিবেদন করেন কৃষ্ণকে। সেই থেকেই শুরু ‘অন্নকূট উৎসব’-এর প্রথা।
বাগবাজারের কড়ুই পরিবারের প্রতিষ্ঠিত নব বৃন্দাবন মন্দিরে প্রতি বছর মহা ধুমধামের সঙ্গে পালিত হয় এই অন্নকূট উৎসব। শ্রী কৃষ্ণের জন্য তৈরি হয় ৩৫০ রকমের পদ। মিষ্টি, ফল, পিঠা, দই, ঘি, নানা রকম রান্না করা অন্ন—সব মিলিয়ে যেন এক কৃষ্ণভোগের মহোৎসব। সকাল থেকে মন্দির প্রাঙ্গণে ভক্তদের ভিড় উপচে পড়ে, আর সন্ধ্যা গড়াতেই চারদিকে শোনা যায় কৃষ্ণনামসংকীর্তনের ধ্বনি।
বাগবাজারের নব বৃন্দাবন মন্দিরের মতোই এই একই দিনে অন্নকূট পালিত হয় বাগবাজারের আরেক প্রাচীন মন্দির, রাধা মদনমোহন মন্দিরে। বাগবাজারের রবীন্দ্র সরণিতে অবস্থিত এই মন্দিরটির প্রায় ২৫০ বছরের পুরোনো। ১৭৬১ খ্রিস্টাব্দে গোকুলচন্দ্র মিত্র প্রতিষ্ঠা করেন এই মন্দির। এই মিত্র পরিবারের ইষ্টদেবতা মদনমোহনের এই বিগ্ৰহটির পেছনে রয়েছে এক চমকপ্রদ ইতিহাস। শোনা যায়, বিষ্ণুপুরের মহারাজ বীর হাম্বির এক ব্রাহ্মণের বাড়িতে আশ্রয় নেন, যেখানে ছিল এই মূর্তি। মূর্তির সৌন্দর্যে মুগ্ধ রাজা সেটি নিজের রাজপ্রাসাদে নিয়ে যান এবং পরবর্তীতে ১৬৯৪ সালে মল্লরাজ দুর্জন সিংহ ওই বিগ্ৰহকে প্রতিষ্ঠা করেন বিষ্ণুপুরের একরত্ন মন্দিরে। ইষ্টকনির্মিত সেই মন্দিরের দেওয়ালে কৃষ্ণলীলা, দশাবতার ও পৌরাণিক কাহিনির ভাস্কর্য খোদাই করা ছিল।
কিন্তু ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের সময় মল্লরাজ চৈতন্য সিংহ অর্থসংকটে পড়ে মদনমোহনের মূর্তিটি বন্ধক রাখেন কলকাতার ব্যবসায়ী গোকুলচন্দ্র মিত্রের কাছে। পরবর্তীতে তিন লক্ষ টাকা দিয়ে মূর্তিটি ফেরত চাইলে, গোকুলচন্দ্র তা দেননি। কিংবদন্তি বলে, তিনি হুবহু একই রকম দেখতে আরেকটি মূর্তি তৈরি করিয়ে বিষ্ণুপুরের রাজাকে পাঠান, আর আসল বিগ্ৰহটি রেখে দেন নিজের ঠাকুরবাড়িতে। আজও সেই আসল মদনমোহনের বিগ্ৰহই পূজিত হন গোকুলচন্দ্র মিত্রের ঠাকুরবাড়িতে।
দোলযাত্রা, রাধাষ্টমী, রাসযাত্রা, ঝুলনযাত্রার পাশাপাশি অন্নকূট উৎসবও মদনমোহন মন্দিরের বার্ষিক আচারসূচির অন্যতম অংশ। বিশেষ এই দিনে কৃষ্ণ ও রাধিকার অন্নভোগ ছোঁড়া হয় ভক্তদের দিকে—যা এক প্রকার আশীর্বাদ হিসেবেই গ্রহণ করেন তাঁরা। ঠাকুরবাড়ির সামনের রাস্তাজুড়ে এই সময়ে ভক্তদের ঢল নামে, পরিবেশ ভরে ওঠে শঙ্খধ্বনি ও কীর্তনে। প্রতিদিন সকাল সাতটা থেকে দুপুর বারোটা এবং বিকেল পাঁচটা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত ভক্তরা দর্শন পান মদনমোহনের। কিন্তু অন্নকূটের দিনে যেন ভক্তিস্রোত আরও গভীর হয়—বাগবাজার জুড়ে তখন শোনা যায় একটাই সুর,“জয় শ্রীকৃষ্ণ!”
চিত্র ঋণ – শান্তনু মালিক
Discussion about this post