পূর্ব বর্ধমান জেলার মন্তেশ্বর ব্লকের খড়মপুর গ্রামের নাম উচ্চারণ করলেই যে দেবীর নাম প্রথম মনে আসে, তিনি মা ভুসো কালী। খড়ি নদীর তীরে অবস্থিত এই প্রাচীন জনপদ শুধু তার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য নয়, বরং তার গভীর সাংস্কৃতিক শিকড়ের কারণেও বিশেষ পরিচিত। স্থানীয় জনশ্রুতি ও পুরাতাত্ত্বিক ইঙ্গিত থেকে জানা যায়, খড়ি নদীর তীরবর্তী অঞ্চল একসময় ছিল তন্ত্রসাধনার অন্যতম কেন্দ্র। অজস্র ঘাট, প্রাচীন শ্মশানক্ষেত্র ও সংস্কার – সব মিলিয়ে এই ভূখণ্ডে শক্তি উপাসনার ঐতিহ্য যুগযুগান্ত ধরে বয়ে চলেছে। খড়মপুরও সেই সাধনাক্ষেত্রেরই একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ, যার প্রাণকেন্দ্রে রয়েছেন মা ভুসো কালী।

ভুসো কালী পুজোর ইতিহাস প্রায় পাঁচ শতাব্দী পুরনো। কথিত আছে, গ্রামের পুরোহিত যামিনী বন্দ্যোপাধ্যায় এক রাতে স্বপ্নাদেশ পান এবং সেই নির্দেশে নিজের মাটির ঘরে স্থাপন করেন এক ক্ষুদ্রাকৃতির কালী মূর্তি। সময়ের প্রবাহে সেই ছোট্ট ঘর আজ মন্দিরে পরিণত হয়েছে, কিন্তু মায়ের পুজোর প্রাচীন রীতি-নীতি আজও অক্ষুণ্ণ। ভুসো কালীর নামের উৎপত্তিও অত্যন্ত বিশেষ। প্রতি বছর অমাবস্যার রাতে মন্দিরে প্রদীপ জ্বালানো হয়, প্রদীপের ওপর রাখা হয় সরা। প্রদীপের তাপ ও ধোঁয়ায় যে ভুসো জমে, সেই ভুসো দিয়েই দেবীর মূর্তি রঞ্জিত করা হয়। কেনা রঙ বা অন্য কোনো উপকরণে মায়ের রূপায়ণ হয় না – এই প্রদীপের ভুসোই হল মায়ের প্রাণ। সেই থেকেই দেবীর নাম ‘ভুসো কালী’।
গ্রামের মানুষদের কাছে এই দেবী কেবলমাত্র এক পূজিত প্রতিমা নন, বরং তিনি হলেন তাদের একমাত্র আরাধ্যা শক্তি। পূর্ব খড়মপুর গ্রামে অন্য কোনো দেবদেবীর প্রতিমা তৈরি বা পুজো করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। দুর্গা, লক্ষ্মী, সরস্বতী, বিশ্বকর্মা বা কার্তিক – কোনো দেবতার প্রতিমাই এই গ্রামে দেখা যায় না। মায়ের প্রভাবে এই গ্রামে এক বিশেষ সামাজিক সংস্কারও চালু আছে – এখানে দোতলা বা বহুতল বাড়ি নির্মাণ করা নিষিদ্ধ। কারণ, জনশ্রুতি অনুসারে কেউই যেন মায়ের উচ্চতা অতিক্রম না করে। বর্তমানে মায়ের মূর্তির উচ্চতা প্রায় বিশ ফুট, যা প্রতি বছর অল্প অল্প করে বৃদ্ধি পাচ্ছে বলেই গ্রামবাসীদের বিশ্বাস।
মা ভুসো কালীর পুজো ঘিরে আজও খড়মপুরবাসী এক অদ্ভুত উচ্ছ্বাসে মেতে ওঠে। দীপান্বিতা অমাবস্যা এলেই গ্রাম জুড়ে শুরু হয় উৎসবের আবহ। রাতভর প্রদীপ জ্বালানো, ভুসো সংগ্রহ, মায়ের রূপদান এবং পুজো – সবকিছুই চলে এক প্রাচীন ঐতিহ্যের ধারায়। অনেকেই বিশ্বাস করেন, মা ভুসো কালীর আশীর্বাদে বহু মুমূর্ষ রোগী আরোগ্য লাভ করেছেন, অনেক পরিবার পেয়েছে অপ্রত্যাশিত শান্তি ও সমৃদ্ধি। তাই কালের স্রোতে বহু পরিবর্তন এলেও, খড়মপুর আজও তার বিশ্বাসে অবিচল। তাদের মতে, মা ভুসো কালীই তাদের গ্রাম, সংস্কৃতি ও জীবনের চিরন্তন কেন্দ্রবিন্দু।
চিত্র ঋণ – সুমন
Discussion about this post