প্রকৃতি, ইতিহাস, স্থাপত্য, রোমাঞ্চ আর নিরিবিলিতে কিছুটা ভ্রমণ। এই সবকিছু একসঙ্গেই, তাও আবার কলকাতা শহরের খুব কাছেই! হালকা শীতের আমেজ, টুকরোটাকরা ছুটি, কমলালেবুর গন্ধে কোন বাঙালি এসব শুনে লাফিয়ে উঠবেন না বলতে পারেন? আজকাল দার্জিলিং, পুরি, দীঘার বাইরেও বাঙালি ঘুরতে যায় আরও দূরে। ভারতবর্ষ তো বটেই, দেশ বিদেশ ঘুরে বেড়ানোটাও এখন খুব অসম্ভব নয়। তবে, যার অভাব, তা হল সময়। তাই আমরা কম সময়ে বেড়ানোর পুরো মজাটাই পেতে চাই। কারণ, বেড়ানোর সময়টুকুকে পুঁজি করেই আমাদের ফিরতে হয় কর্মব্যস্ততায়।
অল্প সময়ে, অল্পদিনের জন্য তাই ঘুরে আসতে পারেন কলকাতা থেকে একটু দূরেই মেদিনীপুরের এই গ্রাম। পশ্চিম মেদিনীপুর শহর থেকে চল্লিশ মিনিট দূর আর ট্রেনে পাঁশকুড়া নেমে সেখান থেকে গাড়ি করেও যাওয়া যায় নাড়াজোল গ্রামে।। ৬০০ বছরের সমৃদ্ধ ইতিহাসের গল্প বয়ে নিয়ে আসছে এই অঞ্চল। এত কাছে যে এমন এক জায়গা রয়েছে তা অনেক পর্যটকের কাছেই এখনও অজানা। ঐতিহাসিকদের মতে, নাড়াজোল রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন উদয়নারায়ণ ঘোষ, যিনি শোনা যায় বর্ধমানের রাজার দেওয়ান হিসেবে কাজ করতেন। আর ইনি ছিলেন ‘ধর্মমঙ্গল’ খ্যাত ইছাই ঘোষের বংশধর। “নাড়াজোল” নামটি দুটি পৃথক শব্দের সমন্বয়ে গঠিত হয়েছে। মেদিনীপুর অঞ্চলের লোকেরা ধান গাছ কাটার পর জমিতে যে অংশটি থেকে যায়, তাকে বলে “নাড়া”। আর “জোল” শব্দটি জেলা বা জলা জমির অপভ্রংশ হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। এই দুই শব্দের মিলনেই সৃষ্টি হয়েছে “নাড়াজোল” নামটির। একপাশে বইছে কংসাবতী অন্য পাশে শিলাবতী নদী।
নাড়াজোল রাজবাড়ি অনেক রোমহর্ষক কাহিনির সাক্ষী। উদয়নারায়ণ ঘোষ নাকি শিকার করতে গিয়ে প্রথম এই জায়গার সন্ধান পেয়েছিলেন। তারপর দুর্গার স্বপ্নাদেশ পেয়ে তিনি ফিরে আসেন এই অঞ্চলে এবং সেখানে প্রচুর ধনসম্পদ পান। এরপরেই উদয়নারায়ণ জয়দুর্গা প্রতিষ্ঠা করেন। প্রায় ৬০০ বছরের প্রাচীন এই ঐতিহ্য আজও বয়ে নিয়ে চলছে রাজবাড়ি। আজও এখানে উদয়নারায়ণের প্রতিষ্ঠিত দুর্গার পুজো হয়। এই রাজবাড়ি পরিদর্শনে এসেছিলেন মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। শান্তিনিকেতনের উপাসনা কক্ষের স্থাপত্য তিনি করেছিলেন এই রাজবাড়ির দুরগার নাটমন্দিরের অলঙ্করণ অনুযায়ী। রাজপরিবারের তহসিলদারের কাজ করতেন বিপ্লবী ক্ষুদিরাম বসুর পিতা ত্রৈলোক্যনাথ বসু। ক্ষুদিরামের এই বাড়িতে নিয়মিত যাতায়াত ছিল। আসতেন বিপ্লবী অরবিন্দ ঘোষ। এসেছিলেন নেতাজী, গান্ধিজি ও জওহরলাল নেহেরুও!
রাজবাড়িটির বংশধরেরা প্রতিবার পুজো ধুমধামের সঙ্গে করলেও বাকি সময় এই অঞ্চল তার সেই প্রাপ্য যত্ন পায়না। রাজবাড়ির ভেতরে দুর্গার মূর্তি রয়েছে। পশ্চিম মেদিনীপুরের প্রাচীন পুজোগুলির মধ্যে একটি হল এই পুজো। তবে, যাঁরা ঐতিহাসিক জায়গাপ্রেমী, তাঁদের জন্য এই নাড়াজোল রাজবাড়ি সেরা। কড়িবরগার ছাদ। চুন সুড়কির দেওয়ালে ফাটল। তাতে গজিয়ে উঠেছে বট, পাকুর, অশ্বত্থের চারা। এই রাজবাড়ি বহন করছে প্রাচীন স্থাপত্যকলার নিদর্শন। রয়েছে প্রাচীন কালের টেরাকোটা শিল্প, খোদাই করা কাঠের কাজ। বাড়ির ভিতরে অসংখ্য ঘর এবং প্রাসাদের মতো উঁচু ছাদ রয়েছে, যা মুঘল এবং বাংলা স্থাপত্যশৈলীর মিশ্রণ। রবীন্দ্রনাথের ‘ভবঘুরে’ কবিতাতে এসেছে এই নাড়াজোলের প্রসঙ্গ। এই অঞ্চল বাংলার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত।
Discussion about this post