মৌলিক বাংলা গানের চর্চাকে এগিয়ে নিয়ে চলার এক অন্যতম সৈনিক কবীর চট্টোপাধ্যায়। পেশা ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে গবেষণা ও শিক্ষকতা, নেশা বাংলা গান লেখা। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজিতে মাস্টার্স। তারপরে আয়ারল্যান্ডে বছর পাঁচেক পি এইচ ডি এবং ছাত্র পড়িয়ে আপাতত কলকাতায় প্রত্যাবর্তন ও বসবাস। বাংলা গান ও শিল্পের বর্তমান অবস্থা, শিল্পের জগতে ফ্যাসিজম, লবিবাজি, বাংলার অর্থনীতির দৈন্যদশা, সবকিছু নিয়েই এক বিকেলে ডেইলি নিউজ রিলের সঙ্গে আড্ডায় শিক্ষক ও শিল্পী কবীর চট্টোপাধ্যায়।
পর্ব – ১
প্রশ্ন: শিক্ষক কবীর চট্টোপাধ্যায় নাকি শিল্পী কবীর চট্টোপাধ্যায়?
কবীর চট্টোপাধ্যায়: আমার কাছে দুটোই জানো তো খুবই গুরুত্ব রাখে। যদি আমার শিক্ষকতা আর আমার লেখালেখি ও গানকে বৃহত্তর অর্থে শিল্প হিসেবে ধরা হয় তাহলে বলব দুটোই আমার কাছে একইরকম প্রয়োজনীয়। দুটোর মধ্যে বিশেষ কোনো তফাত আমি করতে পারিনা। এই দুটোই আমার কাছে কমিউনিকেশনের মাধ্যম। আমার মনের কথা, বা বাইরের পৃথিবীকে দেখে আমার যা মনে হয় সেটাই আমার গান বা আমার শিক্ষকতার মধ্যে ফুটে ওঠে। আর এভাবেই আমি আমার সামনে বসে থাকা মানুষটার সঙ্গে কানেক্ট করতে পারি। সেটা আমার ছাত্রছাত্রীরা হোক বা আমার শ্রোতারা হোক।
দেখবে, ফিজিক্সেও এরকমই একটা বিষয় থাকে। এখানেও মিডিয়ামটা প্রায় একই রকম। এখানেও তুমি একদিকে থাকো আর তোমার উল্টোদিকে থাকে একটা বৃহত্তর জনতা। আর যদি আরো প্র্যাকটিক্যালভাবে বলতে হয়, তাহলে বলবো, দুটোই আমাকে বিভিন্নভাবে সাহায্য করেছে। শিল্পী হিসেবে আমি এমন অনেক জ্ঞান, অনেক শিক্ষা অর্জন করেছি, যা আমার শিক্ষক জীবনে অনেক কাজে এসেছে। যেমন একটা ক্লাসে যদি ৪০ জন ছাত্রছাত্রী থাকে, তাহলে কিভাবে তাদের সঙ্গে ক্রমাগতভাবে কথা বলে যেতে হয়, যাতে কেউ বাদ না পড়ে যায়, সেটা আমাকে শিখিয়েছে আমার শিল্পী সত্তা। আবার এমন অনেক বিষয় আমি শিক্ষক হিসেবে শিখেছি, যা আমার শিল্পকর্মে সাহায্য করেছে।
আমি তো মূলত ১৫ থেকে ১৭ বছরের বাচ্চাদের পড়াই; তাদের চিন্তার জগৎটা, তাদের মনটা অনেকটাই অন্যরকম আমাদের প্রাপ্তবয়স্কদের থেকে। আর তাদের মনে এমন অনেক প্রশ্ন আসে, যেগুলো হয়তো আমরা প্রাপ্তবয়স্করা ভাবতেও পারবনা কোনোদিন। তাদের এইসব প্রশ্নই আমাকে এসব বিষয় নিয়ে ভাবতে বাধ্য করে, আর সেখান থেকেই আমি আমার গান কিংবা লেখালেখির জন্য আইডিয়া খুঁজে পাই। এই কিছুদিন আগেই আমি একটা ভূতের গল্পের সিরিজ শুরু করেছি, যেখানে আমার ছাত্রছাত্রীরা, তাদের পোষ্যরাই হয়ে উঠেছে প্রধান চরিত্র। ফলে বলতে পারো, এই দুটোর মধ্যে একটা খুব সূক্ষ অথচ একটা মিউচুয়াল সম্পর্ক রয়েছে।
প্রশ্ন: এই সাম্প্রতিক ঘটনাবলী, যা আমাদের আশেপাশে প্রতিদিন ঘটছে, সেটা আপনার গানে আপনার লেখায় কিভাবে ছাপ ফেলছে কিংবা কিভাবে আপনার মননকে প্রভাবিত করছে?
কবীর চট্টোপাধ্যায়: ব্যক্তিগতভাবে বলতে গেলে, গানের বা লেখার ক্ষেত্রে খুব একটা বেশি প্রভাব ফেলছে না। কারণ, এই ভয়ঙ্কর সময়গুলো আমাদের বারবার মনে করিয়ে দেয়, এই ক্ষেত্রে আমাদের শিল্পীদের কাজটা একেবারেই গুরুত্বপূর্ণ কাজ নয়। এই সময়ে আমাদের তাদের দরকার বেশি করে যারা ফ্রন্টলাইনে দাঁড়িয়ে লড়াই করছেন, যারা আদালতে, হাসপাতালে, কিংবা তদন্ত কমিটিতে রয়েছেন। আমাদের শিল্পীদের উচিত এইসময় শুধুমাত্র এই মানুষগুলোর পাশে থাকার চেষ্টা করা।
আর দ্বিতীয়ত, আমার গানের ক্ষেত্রে কোনো বিষয় তখনই ছাপ ফেলে, যখন হয়তো একটা ভয়ঙ্কর কোন আবেগের সাথে নিজেকে আমি মানিয়ে নিতে পারছি না সেই সময়। এছাড়া, একটা কোন ঘটনা ঘটলো, আর সেটা ঘটার সঙ্গে সঙ্গেই সেটাকে নিয়ে গান লিখে ফেললাম, সেটা আমি নিজেও অনেকটা সন্দেহের চোখে দেখি। তাই, যেকোনো ঘটনার সূত্র ধরে গান বেঁধে ফেলাটাকে আমি সত্যি কথা বলতে সরাসরি সমর্থন করিনা।
আর আমার গানে কোনো ঘটনা ছাপ ফেললো কি ফেললো না, সেটা সবথেকে সঠিক বলতে পারবেন যারা আমার গান শোনেন। আমার ভিতর থেকে কখন গান বেরোচ্ছে, কেনো বেরোচ্ছে, সেটা যদি আমি আগে থেকেই জেনে যাই, তাহলে শিল্পী হিসাবে সেটা একেবারেই ধৃষ্টতা হয়ে যাবে। তাই সাম্প্রতিক ঘটনার প্রভাবের বিষয়টা আমি আমার দর্শকদের হাতেই ছাড়লাম। তবে হ্যাঁ, একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে সমস্ত রকম সাধু উদ্যোগের পাশে আছি, এটা জোর গলায় বলতে পারি।
প্রশ্ন: একজন সঙ্গীতশিল্পী অত্যন্ত পরিশ্রম করে প্রতিটা গান বাঁধেন, কিন্তু কিছু কালজয়ী গান ছাড়া, বাকি গান জনপ্রিয় হয় না, এটা কেন?
কবীর চট্টোপাধ্যায়: এই প্রশ্নটার, দুটো অংশ রয়েছে। এর মধ্যে প্রথমটা শিল্পী সত্তার প্রশ্ন, আর দ্বিতীয়টা শিল্পের বাজারের প্রশ্ন। হয়তো কোন শিল্পী খুবই ব্যক্তিগত কোনো আবেগের কারণে একটা গান তৈরি করলেন। এই আবেগটা হয়তো তার কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ, তবে এই গানটা বাকিদের মনে তেমন একটা প্রভাব ফেলতে পারল না। সেক্ষেত্রে সেই গানটা জনপ্রিয় হলনা।
আর কালজয়ীর বিষয়টা তো অনেকটাই আগামী প্রজন্মের শ্রোতাদের, সমালোচকদের উপর নির্ভরশীল। এরকম বহু গান রয়েছে, যেগুলো এখন মানুষের মুখে মুখে ঘুরছে, কিন্তু আগে যখন কোন শিল্পী সেই গানটা তৈরি করেছিলেন, সেই সময় সেই গানটা একেবারেই সমাদর পায়নি। আর এটা সমস্ত ভাষার গানের ক্ষেত্রেই হয়। মহীনের ঘোড়াগুলি ব্যান্ডের এমন অনেক গান এখন মানুষের মুখে মুখে ঘোরে, কিন্তু সেই সময় যখন তারা গানটা তৈরি করেছিলেন তখন মানুষ রীতিমতো তাচ্ছিল্যই করেছিলেন। ফলে, কোনো গানের কালজয়ী হওয়ার বিষয়টা পুরোপুরি পরবর্তী প্রজন্মের উপরেই নির্ভর করছে।
প্রশ্ন: এই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যুগে বাংলা মৌলিক গানের ভবিষ্যৎ কতটা উজ্জ্বল?
কবীর চট্টোপাধ্যায়: ব্যক্তিগতভাবে, আমার কখনোই মনে হয় না আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স এখনো সেই জায়গায় পৌঁছেছে, বা ভবিষ্যতেও সেই জায়গায় পৌঁছবে, যে একজন রক্তমাংসের মানুষের মনের ভাব হুবহু প্রকাশ করতে পারবে। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সকে চালাতে গেলে একটা ইনপুট ও প্যারামিটারের প্রয়োজন হয়, যেটা একটা মানুষের মাথা থেকেই আসতে পারে। ফলে, ব্যক্তিগতভাবে আমার মনে হয়না, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স কখনোই একজন শিল্পীর জায়গা দখল করতে পারবে।
তবে হ্যাঁ, কিছু কিছু ক্ষেত্রে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ব্যবহার করা যেতে পারে। কোন জিঙ্গল তৈরিতে, কোনো বিজ্ঞাপনের গানের লিরিক্স লেখার ক্ষেত্রে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের ব্যবহার হয়তো ভবিষ্যতে করা সম্ভব হবে। আর, দিনের শেষে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স তৈরিই তো হয়েছে এই কারণে, যাতে সে মানুষের জীবনের একঘেয়ে কাজগুলো নিমেষের মধ্যে করে ফেলে। আর সেই মানুষটি আরো বড় ভালো কাজগুলো চুটিয়ে করতে পারে। ফলে, আমার মনে হয়না এআই কখনো পুরোপুরি একজন শিল্পীর জায়গাটা নিতে পারবে।
প্রশ্ন: রিয়েলিটি শো কি শিল্পী তৈরি করে নাকি শুধুই তারকা তৈরি করে?
কবীর চট্টোপাধ্যায়: দেখো, রিয়ালিটি শো যে একেবারেই শিল্পী তৈরি করে না, সেটা বলা ভুল। তবে আমি বলব যদি শিল্পী তৈরি হয়, সেটা ব্যতিক্রম। কারণ, রিয়ালিটি শোয়ের মাধ্যমে ছোট ছোট শিল্পীদের এমন একটা ধাঁচের মধ্যে ফেলে দেওয়া হয়, যে তাদের মধ্যেকার শিল্পের প্রতি সঠিক আগ্রহটা অনেকটাই হারিয়ে যায়, বরং তৈরি হয় তারকা হয়ে ওঠার একটা খিদে। একারণে, ভবিষ্যতে সে সেভাবে ক্রিয়েটিভ কোনো কাজ আর করতে পারে না। তবে হ্যাঁ, তারকা তৈরি করে তো অবশ্যই। রিয়েলিটি শো এর বিষয়টা এলেই আবার সেই গানের বাজারের প্রসঙ্গটা উঠে আসবে। গানের জগত শিল্পী তৈরি করলেও গানের বাজার কিন্তু তৈরি করেন তারকারা, আর প্রডিউসাররা। ফলে হ্যাঁ, রিয়েলিটি শোকে একপ্রকার এই গানের বৃহত্তর বাজারের অংশই বলা চলে।
চলবে…
Discussion about this post