দরজায় কড়া নাড়ছে বাঙালির অন্যতম প্রিয় উৎসব কালী পুজো। বাঙালির সংস্কৃতি ও ধর্মীয় বিশ্বাসের সঙ্গে মা কালীর একটি গভীর সম্পর্ক রয়েছে। তাঁকে মহাশক্তির প্রতীক হিসেবে দেখা হয়। পশ্চিমবঙ্গ, বিশেষ করে কলকাতা, মা কালীর আরাধনার জন্য বিখ্যাত। রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে অসংখ্য কালীবাড়ি রয়েছে, এর মধ্যে প্রায় প্রত্যেকটির নিজস্ব ইতিহাসও রয়েছে। এই মন্দিরগুলি কেবল ধর্মীয় কেন্দ্রই নয়, বরং সাংস্কৃতিক ও সামাজিক জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। গঙ্গার তীরে অবস্থিত শেওড়াফুলির নিস্তারিণী কালী মন্দির পশ্চিমবঙ্গের অন্যতম একটি কালীবাড়ি।
ইতিহাস অনুযায়ী, ১৮২৭ সালে বর্ধমানের পাটুলির রাজা তথা শেওড়াফুলি রাজবংশের হরিশচন্দ্র রায় এই মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেন। রাজা হরিশচন্দ্র ছিলেন পরম ধার্মিক, নিষ্ঠাবান ও মা কালীর ভক্ত। জানা যায়, রাজার তিন রানি ছিল। প্রায় প্রতিদিনই রানিদের মধ্যে অশান্তি লেগে থাকত। একদিন রাজা নারায়ণপুর প্রাসাদে ফিরে দেখেন তিন রানি ঝগড়া করছেন, এই দৃশ্য দেখে রাজা ভয়ংকর রেগে যান। ক্রোধে তরবারি দিয়ে বড় রানিকে হত্যা করেন। এই ঘটনার পর রাজা প্রচন্ডভাবে বিষণ্ণ হয়ে পড়েন। অনুতপ্ত ও অনুশোচনায় জর্জরিত রাজা প্রাসাদ থেকে পালিয়ে গিয়ে আত্মহত্যারও চেষ্টা করেন কিন্তু কোনও কারণে তিনি ব্যর্থ হন।
পরে ঘুরতে ঘুরতে তিনি গভীর জঙ্গলে এক গাছের তলায় আশ্রয় নেন। এরপর তিনি অবসাদগ্রস্ত অবস্থায় ক্লান্ত হয়ে এক সময় ঘুমিয়ে পড়েন। সেদিন দেবী কালিকা রাজা হরিশচন্দ্রকে স্বপ্নাদেশ দেন। দেবী রাজাকে গঙ্গাতীরে একটি মন্দির প্রতিষ্ঠা করতে বলেন। এরপর রাজা দেবীর নির্দেশ মেনে শেওড়াফুলিতে গঙ্গার তীরে মা কালীর মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। আর রাজা যে কালো পাথরটির ওপর আশ্রয় নিয়েছিলেন সেই পাথর দিয়েই দেবীর মূর্তি নির্মাণ করা হয়। কথিত আছে, স্ত্রীর মৃত্যুর এই ঘটনার হাত থেকে নিস্তার পেতেই এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন রাজা। তাই এই মন্দির নিস্তারিণী কালীবাড়ি নামেই পরিচিত।
এই মন্দিরে পঞ্চমুণ্ডির আসনে একটি তামার পদ্মাসনের ওপর বিগ্রহ প্রতিষ্ঠিত। এছাড়াও আছে, কালী বিগ্রহের পদতলে শায়িত অবস্থায় শিব। শুধু রাজা হরিশচন্দ্র নন এই মন্দিরের সঙ্গে রানী রাসমণির নামও জড়িত। রানী রাসমণি, যিনি দক্ষিণেশ্বর কালী মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তিনিও নিস্তারিণী দেবীর দর্শন করতে শেওড়াফুলি এসেছিলেন। লোকমুখে প্রচলিত, রানী রাসমণিকে ছোট্ট বালিকা রূপে দর্শন দিয়েছিলেন মা নিস্তারিণী। সারা বছরই নিস্তারিণী কালীবাড়িতে মায়ের পুজো হয়। প্রত্যেক অমাবস্যায় বিশেষ পুজার্চনা করা হয়। এখানে ছাগবলির প্রথা এখনও প্রচলিত রয়েছে। প্রতি বছর হাজার হাজার ভক্ত এই মন্দিরে আসেন মায়ের দর্শন করতে।
চিত্র ঋণ – পীতম্বর পারুই, কার্তিক বিশ্বাস, বিমান চ্যাটার্জী, তন্ময় সামন্ত
Discussion about this post