বাংলা থিয়েটারের ইতিহাসে সবথেকে জনপ্রিয় অভিনেত্রীদের তালিকায় হয়তো এক নম্বরে থাকবেন বিনোদিনী দাসী। এখনো তিনি একই রকমভাবে থিয়েটারের জগতে আলোচিত এবং জনপ্রিয়। কিন্তু তাঁরই মত আরো কয়েকজন শিল্পী ছিলেন যারা, নাট্যকার গিরিশ ঘোষের ছত্রছায়ায় এসে, দায়িত্ব নিয়ে পাঁকে পদ্ম ফুটিয়েছিলেন। অথচ, তাঁরা রয়ে গেলেন সমাজের সেই অন্ধকার কুহরেই। এরকমই একজন মঞ্চ অভিনেত্রী ছিলেন তিনকড়ি দাসী।
বাংলার অভিনয় জগতের সেই সময়টা ছিল প্রধানত পুরুষকেন্দ্রিক। অনেক ক্ষেত্রে, পুরুষরাই অত্যধিক মেকআপ করে নারী সেজে মঞ্চে অভিনয় করতেন। তথাকথিত ভালো ঘরের মেয়েরা মঞ্চে অভিনয়ের দিকে পা বাড়াতেন না। কিন্তু, নাট্যকার গিরিশ ঘোষ ভাবলেন, সমাজের সম্ভ্রান্ত ঘরের মেয়েরা নন, বরং তাঁর নাটকে অভিনয় করবেন সমাজের ব্রাত্য মেয়েরা। এই ভেবেই কলকাতার নিষিদ্ধ পাড়া থেকে প্রথমে কিরণবালা এবং তারপর তিনকড়ি দাসীকে নাট্য অঙ্গনের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন গিরিশ ঘোষ। যদিও সেই সিদ্ধান্তের সমালোচনা হয়েছিল বিস্তর। এমনকি একটি পত্রিকায় বেঙ্গল থিয়েটারের সমালোচনা করে লেখা হয়, “বেশ্যাদের মঞ্চে এনে নাটককে যাত্রার স্তরে নামিয়ে দিয়েছেন এরা।” তবে, গিরিশ ঘোষ দমে যাননি। তাদের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে তিনকড়ি দাসীকে মুখ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে নাটকের জগতে এক বিপ্লব নিয়ে আসেন গিরিশ ঘোষ।
তিনকড়ি দাসীর মা ছিলেন কলকাতার নিষিদ্ধপল্লীর যৌনকর্মী। তাচ্ছিল্যের দুনিয়া থেকে মুক্তি পেতে অভিনয়কেই অস্ত্র বানিয়েছিলেন তিনকড়ি দাসী। তিনি যখন গিরিশ ঘোষের বিল্বমঙ্গল নাটকে প্রথমবারের জন্য অভিনয় করেন, সেই সময় তিনি নির্বাক সখীর ভূমিকা পালন করেছিলেন। তবে, প্রকৃত অভিনেত্রী হিসেবে তাঁর আত্মপ্রকাশ গিরিশ ঘোষের মীরাবাঈ নাটকে, নাম ভূমিকায়। এরপর ১৮৯৩ সালে লেডি ম্যাকবেথ ভূমিকায় অভিনয় করে বেশ প্রশংসিত হন তিনকড়ি। এরপরে গিরিশবাবুর আরো বেশ কয়েকটি নাটকের প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেন তিনকড়ি।
একটা সময় তিনি ছিলেন বাংলার রঙ্গমঞ্চের সর্বশ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী। অভিনয়ের প্রতি তাঁর এতই টান ছিল যে, একটা সময়ে ২০০ টাকার বিনিময়ে রক্ষিতা হওয়ার প্রস্তাব ছেড়ে দিয়ে তিনি ৪০ টাকার বিনিময়ে অভিনয় চালিয়ে যান। ২০০ টাকার সেই লোভনীয় প্রস্তাব ত্যাগ করায় মায়ের পেটানিও জুটেছিল ভাগ্যে। তবে, জীবনের শেষ দিকটায় আর অভিনয় চালিয়ে যেতে পারেননি তিনকড়ি। শেষের ২০ বছর এক বাবুর রক্ষিতা হয়েই দিন কাটিয়েছিলেন তিনি। তবে শোনা যায়, সেই বাবু নাকি তাকে বেশ যত্নেই রেখেছিলেন। মৃত্যুর সময় ওই বাবুর কাছ থেকে ৩টি বাড়িও পেয়েছিলেন তিনকড়ি, যার মধ্যে একটি তিনি দান করেছিলেন বাবুর ছেলেকে আর বাকি দুটি ১৯১৭ সালে মৃত্যুর আগে দিয়ে গিয়েছিলেন হাসপাতাল তৈরির জন্য। এই তিনকড়িরা, যতই ভালো কাজ করুন না কেনো, পতিতাপল্লীর এই মহিলাদের জীবন-কলস হতাশা, উপেক্ষা আর দুঃখেই ভরা থাকবে চিরকাল।
Discussion about this post