বৈদ্যনাথ ভট্টাচার্য কে? একবারে নাম বলামাত্রই চিনে ফেলা একেবারেই সহজ নয়। অন্তত, আম-বাঙালির পক্ষে তো নয়ই। কারন আমরা সকলেই তাঁকে চিনি তাঁর ছদ্মনামে। বলতে গেলে তাঁর ছদ্মনামটাই, তাঁর আসল পরিচয় হয়ে উঠেছিল ক্রমে ক্রমে। বাণীকুমার। ঠিকই ধরেছেন। বাণীকুমার নামটা উচ্চারণ করলেই বাঙালির মনে অবধারিতভাবে একটা শব্দ ভেসে ওঠে – মহালয়া। হ্যাঁ, প্রতিবছর মহালয়ার ভোরে বাঙালির ঘরে ঘরে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের অমোঘ উচ্চারণে যে সংস্কৃত শ্লোকের অনুপ্রবেশ ঘটে, তাঁর রচনা এবং সংকলন পুরোটাই বাণীকুমার ওরফে বৈদ্যনাথ ভট্টাচার্যের। তাঁর ক্ষুরধার লেখনীতেই অমরত্ব পেয়েছে আকাশবাণীর ‘মহিষাসুরমর্দিনী’।
১৯৩২ খ্রিস্টাব্দের চৈত্র মাসে বাসন্তী এবং অন্নপূর্ণা পূজার সন্ধিক্ষণে আকাশবাণীতে প্রথম সম্প্রচার হয়েছিল ‘বসন্তেশ্বরী’, যা ছিল মার্কণ্ডেয় চণ্ডীর উপর ভিত্তি করে বাণীকুমারের লেখার বেতাররূপ। সেই বসন্তেশ্বরী অনুষ্ঠানের অনুকরণেই, কিছু পরিমার্জনের মাধ্যমে সেই বছর দুর্গা ষষ্ঠীর দিন অনুষ্ঠানটি সম্প্রচার করা হয় আকাশবাণীতে। সেই অনুষ্ঠানের সংগীত পরিচালনা করেছিলেন রাইচাঁদ বড়াল, এবং চণ্ডীপাঠ করেছিলেন বাণীকুমার স্বয়ং। এরপর, ১৯৩৭ সালে এই অনুষ্ঠানের শ্লোকে বেশ কিছু পরিবর্তন নিয়ে আসা হয় এবং সেবছর থেকে চণ্ডীপাঠের দায়িত্ব নেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র। সঙ্গেই অনুষ্ঠানের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ‘মহিষাসুরমর্দিনী’, যা এখনো একই নামে প্রতিবছর মহালয়ার ভোরে সম্প্রচারিত হয়।
একটা সময়ে, মহিষাসুরমর্দিনী ছাড়াও নিজের লেখার জন্য বহু খ্যাতি অর্জন করেছিলেন বাণীকুমার। ত্রিশের দশকে প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়াকালীন সময়ই মহাকবি ভাস রচিত ‘শোণিত পারনা’ নাটকের বাংলা অনুবাদ করেছিলেন বাণীকুমার। এছাড়াও, ১৯৪৭ সালে রবীন্দ্রনাথের ‘বাঁশরী’-র নাট্যরূপ দিয়েছিলেন তিনি। ১৯৪৯ সালে ‘ঘরে বাইরে’, ‘দুই বোন’, ১৯৫০ এ ‘যোগাযোগ’-র নাট্যরূপ আসে বাণীকুমারের হাত ধরে। এছাড়াও, বঙ্কিমের ‘দুর্গেশনন্দিনী’, ‘আনন্দমঠ’, শরৎচন্দ্রের ‘অরক্ষণীয়া’, ‘মেজদিদি’, রবীন্দ্রনাথের ‘গুপ্তধন’, ‘মাস্টারমশাই’, ‘রামকানাইয়ের নির্বুদ্ধিতা’, ‘সুয়োরাণীর সাধ’-র মতো রচনার নাট্যরূপ দিয়েছেন বাণীকুমার। তবুও, যে সম্মান তাঁর প্রাপ্য ছিল, সেটা তিনি কোনোদিনই পাননি। বরং, চিরকাল পর্দার আড়ালে থেকেই জীবনটা কাটিয়ে দিয়েছেন বাণীকুমার।
বৈদ্যনাথ ভট্টাচার্য ওরফে বাণীকুমারের জন্ম তাঁর মামাবাড়িতে, হাওড়ার কানপুর গ্রামে। পৈতৃক বাড়ি ছিল হুগলির আঁটপুর গ্রামে। বাবা ছিলেন ইতিহাসবিদ পন্ডিত বিধুভূষণ ভট্টাচার্য। বাণীকুমারের জীবনের একটা দীর্ঘ সময় কেটেছে এই কানপুরের বাড়িতেই। হাওড়া জিলা স্কুলে পড়াকালীন সময়টাও তিনি এই বাড়িতেই থাকতেন। এই বাড়ির সাথে লেখকের অনেক স্মৃতি জড়িয়ে রয়েছে। অথচ সেই গুণী মানুষটির বসত ভিটেই, আজ সংস্কারের অভাব আর অবহেলায় পোড়োবাড়ির চেহারা নিয়েছে। প্রবল অবহেলা এবং অযত্নে লেখকের জন্মস্থান আজ রীতিমতো জঙ্গলাকীর্ণ। স্থানীয়রা কয়েকবছর বাড়িটি রক্ষণাবেক্ষণের চেষ্টা করলেও, সরকার কখনোই এই বাড়ি সংরক্ষণে সচেষ্ট হয়নি। ফলে, কালের নিয়মে, সঠিক পরিচর্যার অভাবে, লেখকের হাওড়ার কানপুরের বসতবাড়ি আজ শুধুমাত্র বিষাক্ত পোকামাকড় এবং সাপের আঁতুড়ঘর হয়ে রয়েছে।
Discussion about this post