সুন্দরবন, নামটার মধ্যেই যেন লুকিয়ে আছে প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য্য আর রহস্যময়তার মিশেল। প্রকৃতির এমন এক অপূর্ব সৃষ্টি, যেখানে রয়েছে নদী, বন, ও জীববৈচিত্র্যের এক অনন্য সহাবস্থান। কিন্তু সুন্দরবন মানে শুধুই যে সুন্দর সেটা কিন্তু নয়, এর গহন অরণ্যে লুকিয়ে আছে ভয়ও। আর সেই ভয়ের নাম — রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার। সুন্দরবনের অধিকাংশ মানুষই বনজীবী। বলতে গেলে, মধু সংগ্রহ করে এবং নদীতে মাছ ধরেই তাদের জীবন-জীবিকা চলে। বাংলাদেশের এরকম একটি সুন্দরবন ঘেঁষা গ্রামেই জন্ম আব্দুল গনি গাজীর। তবে আজ এই নামে নন বরং সারা সুন্দরবনের মানুষের কাছে তিনি পরিচিত গনি টাইগার নামে।
ছোট থেকেই তার একটা গুণ ছিল, তিনি সবার বিপদে পাশে দাঁড়ানোর জন্য ঝাঁপিয়ে পড়তেন। তার এই গুণই তাকে সুযোগ করে দেয় বাংলাদেশ সুন্দরবন ওয়াইল্ড টিমের সঙ্গে কাজ করার। তখন সালটা ২০০৭। সেবছর বাংলাদেশ বনদপ্তরের কাছ থেকে অনুমতিপত্র নিয়ে সুন্দরবনে মধু সংগ্রহ করতে গিয়েছিলেন বেশ কয়েকজন মৌয়াল। কিন্তু, দুর্ভাগ্যবশত তাদের মধ্যে একজন ব্যক্তি বাঘের হাতে প্রাণ হারান। নিহত ব্যক্তির দেহ বাড়ির লোকেদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব পড়ে ওয়াইল্ড টিমের ওপর। তাদের সঙ্গে জঙ্গলে ঢুকে পড়েন গনিও। এই অভিযানে গনির বীরত্ব দেখে মুগ্ধ হয়ে তাকে বনদপ্তরের সঙ্গে চুক্তিভিত্তিকভাবে কাজ করার অনুমতি দেওয়া হয়।
তার প্রথম বড় মিশন ছিল ২০০৯ সালে, যখন তার দায়িত্বাধীন এলাকার এক ব্যক্তি বাঘের আক্রমণে প্রাণ হারান। দু’দিনের দীর্ঘ অনুসন্ধানের পর বাঘের হাত থেকে সেই ব্যক্তির মৃতদেহ উদ্ধার করতে সক্ষম হয় তার টিম। সেই অভিযানে বাঘের সঙ্গে সরাসরি মোকাবিলাও করতে হয়েছিল তাকে। এক হাতে লাঠি নিয়ে চিৎকার করে বাঘকে সরিয়ে দিয়েছিলেন গনি। আর তারপর থেকেই তিনি পরিচিত হয়ে ওঠেন গনি টাইগার নামে। এ পর্যন্ত সুন্দরবনে বাঘের আক্রমণের শিকার হয়ে জীবিত ও মৃত শতাধিক মানুষকে উদ্ধার করেছেন তিনি।
২০১৯ সালে তার কাজের মেয়াদ শেষ হলেও, যতদিন দেহে বল আছে, নিজের কাজটা করে যেতে চান গনি টাইগার। ২০২১ সালে গাবোরা ইউনিয়নে একটি মিশনে অংশ নেন গনি, যেখানে মুজিবুর ও ইসমাইল নামে দুই ব্যক্তি বাঘের আক্রমণে প্রাণ হারিয়েছিলেন। তাদের দেহ উদ্ধারের মিশনেও উদ্ধারকারী দলকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন এই গনি টাইগারই। তবে শুধু বাঘের আক্রমন থেকে মানুষদের উদ্ধার নয়, বাঘ সংরক্ষণের জন্যেও কাজ করেছেন গনি। ওয়াইল্ড টিমের সদস্য হিসেবে সুন্দরবনের আশেপাশের বিভিন্ন গ্রামে গিয়ে মানুষজনদের সচেতন করেছেন তিনি। এছাড়াও, বাঘের উপস্থিতির আশঙ্কা থাকলে, কীভাবে সেখান থেকে বেরিয়ে আসা যায়, সে নিয়েও বিশেষ প্রশিক্ষণ দিতেন গনি। তার কাজ শুধুমাত্র আর্থিক লাভের জন্য নয়, বরং সুন্দরবনের মানুষকে বাঘের আক্রমণ থেকে রক্ষা করা এবং তাদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্যও। এই মহৎ কাজকে তিনি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত চালিয়ে যাওয়ার সংকল্প নিয়েছেন।
Discussion about this post