সরকারি চাকরির প্রতি ভারতীয়দের একটা অমোঘ আকর্ষণ চিরকালের। বর্তমানে অনিশ্চয়তায় ভরা চাকরির বাজারে নিশ্চিত সরকারি চাকরি লাভের আশায় ভারতের লক্ষ লক্ষ যুবক যুবতী লড়াই করে চলেছেন প্রতিদিন। লড়াইয়ের শেষে সবার লক্ষ্য একটাই, UPSC। ভারতের UPSC পরীক্ষার প্রতি মানুষের আকর্ষণ অভূতপূর্ব, কিন্তু এই পরীক্ষার কঠিন পথ অতিক্রম গেলে যে কতটা পরিশ্রম ও সাহসের প্রয়োজন, তা অনেকের পক্ষে কল্পনাতীত। এই পরীক্ষার সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছানোর স্বপ্ন দেখেন বহু প্রতিভাবান মানুষ। তার মধ্যেও কিছু কিছু কাহিনি এমনভাবে আমাদের প্রেরণা দেয় যে, সেগুলি কেবল স্বপ্ন দেখাই নয়, বাস্তবে কিভাবে সফল হতে হয় তারও নিদর্শন হয়ে ওঠে। প্রাঞ্জল পাটিলের গল্প এমনই এক অনুপ্রেরণার কথা।
প্রাঞ্জল পাটিল ১৯৮৮ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর মহারাষ্ট্রের উলহাসনগরে জন্মগ্রহণ করেন। মাত্র সাত বছর বয়সে দৃষ্টিশক্তি হারানোর পর, সাধারণভাবে কেউ যদি নিজেকে অক্ষম মনে করতেন, তাহলে হয়তো স্বপ্ন ও লক্ষ্যকে পরিত্যাগ করে নিজের ভাগ্যকে দোষারোপ করেই তিনি বাকি জীবনটা কাটিয়ে দিতেন। কিন্তু প্রাঞ্জল তার দৃঢ় মানসিকতা ও অদম্য শক্তি দিয়ে এই সীমাবদ্ধতাকে ভেঙে দিয়ে এক নতুন পথের সন্ধান করলেন। প্রাঞ্জল পাটিলের জীবন সংগ্রামের শুরু হয় মুম্বাইয়ের কমলা মেহতা, দাদর স্কুল ফর দ্য ব্লাইন্ড থেকে, যেখানে তিনি তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা অর্জন করলেন। পরবর্তীতে তিনি মুম্বাইয়ের সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। এরপর, জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ওপর স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভের পর, তিনি পিএইচডি এবং এম.ফিল ডিগ্রিও অর্জন করেন একই বিষয়ে।
তবে, এখানেই তিনি থেমে যাননি। এরপরেই শুরু হলো তার UPSC পরীক্ষার পথচলা। প্রথমবার UPSC পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন ২০১৬ সালে, যেখানে তার র্যাঙ্ক ছিল ৭৪৪। প্রথমবারের প্রচেষ্টাতেই তিনি হয়ে যান সফল। তবে কাঙ্খিত সাফল্য প্রথমবারে আসেনি। তিনি নির্বাচিত হয়েছিলেন বটে, তবে IAS এর জন্য নয়, অন্য সিভিল সার্ভিসের জন্য। তাই নিজের IAS হওয়ার স্বপ্নকে জিইয়ে রেখে দ্বিতীয় বার, ২০১৭ সালে তিনি আবারও UPSC পরীক্ষায় বসেন। কঠোর পরিশ্রমের পর অবশেষে দ্বিতীয়বারের পরীক্ষায় নিজের লক্ষ্য পূরণে সফল হন প্রাঞ্জল। ২০১৭ সালের UPSC পরীক্ষায় AIR ১২৪ অর্জন করে, তিনি ভারতের প্রথম দৃষ্টি প্রতিবন্ধী IAS অফিসার হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। এমন একটি বিপুল অর্জনকে তিনি করলেন, কোনো কোচিং ছাড়াই। তার প্রস্তুতির প্রক্রিয়ায়, প্রাঞ্জল বিশেষ সফটওয়্যার ব্যবহার করেছিলেন যা দৃষ্টিহীন ব্যক্তিদের জন্য ডিজাইন করা হয়েছিল। ২০১৭ সালের সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় সফল হওয়ার পর, ২০১৮ সালে কেরালার এর্নাকুলামে সহকারী কালেক্টর হিসেবে তার প্রথম পদায়ন ঘটে। তার দৃষ্টিহীনতার কারণে ভারতীয় রেলওয়ে অ্যাকাউন্টস সার্ভিসে যোগদান থেকে তাকে বিরত রাখা হয়েছিল, কিন্তু প্রাঞ্জল তাঁর পরিশ্রম ও দৃঢ় সংকল্পের মাধ্যমে নিজের লক্ষ্যে পৌঁছাতে সক্ষম হন। বর্তমানে, তিনি তিরুবনন্তপুরমের সাব-কালেক্টর এবং কেরালায় দক্ষতার সঙ্গে কাজ করছেন। প্রাঞ্জলের এই অনুপ্রেরণামূলক গল্প আমাদের শেখায় যে, শারীরিক সীমাবদ্ধতা আমাদের স্বপ্ন পূরণের পথে বাধা নয়। সত্যিকারের সফলতা হলো আত্মবিশ্বাস এবং সংকল্পের ফল। তার জীবন কেবল প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে লড়াই করার সাহসী উদাহরণই নয়, বরং প্রতিটি মানুষের মনে নিজস্ব সম্ভাবনার দিকে এক নতুন আলো ফেলেছে।
Discussion about this post