ভারত, যা ‛চিত্রকলার দেশ’ নামে পরিচিত, বিশ্বের প্রাচীনতম ও সমৃদ্ধতম শিল্প-ঐতিহ্যের অধিকারী। প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে শুরু করে আধুনিক যুগ পর্যন্ত ভারতীয় শিল্পীরা তাদের অসাধারণ দক্ষতা ও সৃজনশীলতার মাধ্যমে দেওয়াল, ক্যানভাস, পোটারি এবং অন্যান্য মাধ্যমে অমূল্য শিল্পকর্ম সৃষ্টি করেছেন। এরকমই এক ধরনের বিশেষ শিল্পকর্ম হল পাইটকর চিত্রকলা। পাইটকর চিত্রকলা ঝাড়খণ্ডের আদিবাসী সংস্কৃতির একটি মূল্যবান সম্পদ। বলা যায়, পাইটকর চিত্র হল গানের মাধ্যমে এক ধরনের গল্প বলা। এই গানগুলি মূলত বাংলা ভাষায় করা হয়। ঝাড়খণ্ডের পূর্ব সিংভূম জেলার ধলভূমগড় অঞ্চলের আমাডুবি গ্রামে এই বিশেষ লোকশিল্প ‘পাইটকর চিত্রকলা’ বিখ্যাত।
![](https://dailynewsreel.in/wp-content/uploads/2024/07/1-724x1024.jpg)
কথিত আছে, ধলভূমগড়ের রাজা রামচন্দ্র ধলের রাজত্বকালে প্রায় ২২ জন পাইটকর শিল্পীর একটি দল এই গ্রামে আসেন। চিত্রাঙ্কন এবং গানের অসাধারণ দক্ষতার জন্য এই শিল্পীদের রাজা তার রাণীর শয়নকক্ষকে সজ্জিত করার দায়িত্ব দেন। তাদের কাজে খুশি হয়ে রাজা শিল্পীদের পুরস্কৃত করেন। এরপর থেকে, শিল্পীরা এই গ্রামেই বসতি স্থাপন করেন। অতীতে এই শিল্পীদের বলা হত ‘গায়েন’, কিন্তু ধীরে ধীরে তারা তাদের উপাধি পরিবর্তন করে রাখে ‘চিত্রকর’। গায়কদের বলা হয় ‘গায়েন’ এবং চিত্র শিল্পীদের বলা হয় ‘চিত্রকর’।
স্থানীয় শব্দ ‘পাটেকর’ থেকে এই শিল্পের নামটি এসেছে। এটি মূলতঃ স্ক্রল পেইন্টিং। এই চিত্রের মাধ্যমে বিভিন্ন হিন্দু পুরাণের কাহিনী (যেমন – রামায়ণ, মহাভারত), সামাজিক ও ধর্মীয় সংস্কৃতিগুলিকে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেন শিল্পীরা। পাইটকর চিত্রের ক্ষেত্রে যে মানব-মানবী আঁকা হয় তাদের চোখ হয় প্রসারিত – এরূপ চোখের ধরণ হল এই চিত্রকলার মূল বৈশিষ্ট্য। পাইটকর চিত্র তৈরির জন্য শিল্পীরা যে রঙ ব্যবহার করেন তা সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক উপাদান দিয়ে তৈরি করা হয়। যেমন – লাল রঙের জন্য ব্যবহার করা হয় হেমাটাইট (গেরুয়া পাথর), হলুদ রঙের জন্য হলুদ ওচার পাথর, কালো রঙের জন্য ল্যাম্প সুট বা কার্বন ব্ল্যাক, বাদামির জন্য বাদামি পাথর। আবার কমলা রঙ তৈরি হয় পলাশ ফুল থেকে এবং সবুজ রঙের জন্য ব্যবহার হয় শিমের পাতা। পাইটকর শিল্পী বিজয় চিত্রকরের থেকে জানা যায়, “পাহাড়-টিলা কিংবা নদীর ধারে যেতে হয়; কখনও কখনও চুনাপাথর খুঁজে পেতে পেতে তিন-চারদিন লেগে যায়।”
অতীতে পাইটকর শিল্পীরা কাঠবেড়ালি ও ছাগলের লোম দিয়ে তুলি তৈরি করতেন এবং তা বাঁশের লাঠিতে বেঁধে ব্যবহার করতেন। কিন্তু বর্তমানে শিল্পীরা রঙ করার জন্য ব্রাশ ব্যবহার করেন। চিত্রকররা গাছের ছাল, পাতা, জামা-কাপড় এবং দেওয়ালকে ক্যানভাস হিসেবে ব্যবহার করে এই সুন্দর চিত্রগুলিকে সমগ্র বিশ্বের মানুষদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করছেন। আর বর্তমানে হাতে তৈরি কাগজই ক্যানভাস হিসেবে ব্যবহার করছেন অসংখ্য শিল্পী। এটি ঝাড়খণ্ডের একটি ঐতিহ্যবাহী শিল্প হলেও বর্তমানে এটি ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে। কারণ অনেক শিল্পীই এই চিত্রকর্মের কাজ ছেড়ে অন্যান্য পেশা বেছে নিচ্ছেন পেটের দায়ে। এই গ্রামের এই চিত্রশিল্পী গণেশ গায়েন যিনি এখন মুদির দোকান চালান তাঁর কথায়, “গতবছর মোটে তিনখানা ছবি বিকতে পেরেছিলাম। শুধু এটার রোজগারে বসে থাকলে ঘর-সংসার লাটে উঠবে যে।” তবে বর্তমানে সরকার এই শিল্পটিকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য চেষ্টা চালাচ্ছে।
প্রচ্ছদ চিত্র ঋণ – লাভলী মজুমদার
Discussion about this post