রেল সমুদ্র? তার আবার উপকূল! সেটা ঠিক কী রকম? আদৌ কি এরকম কোনও জলহীন সমুদ্র উপকূলের অস্তিত্ব আছে? প্রশ্নের সদুত্তর অবশ্যই মিলবে যদি হাওড়া স্টেশনে ট্রেন ঢোকার কিছুক্ষণ আগে একটু কষ্ট করে বাঁদিকে ঘাড়টা ঘোরানো যায়। যেদিকে বিপুল রেললাইনের সারি, ঠিক তার বিপরীতে এক জনবসতি। স্বাভাবিকভাবেই মনে প্রশ্ন জাগে যে, ঠিক কী রকম তাদের এই রেলময় জীবন? তাই শুধুমাত্র কৌতূহলের পরিতৃপ্তির তাগিদেই এক দুপুরে হাজির হওয়া গেল সেই রেলসমুদ্র সৈকতে। এই এলাকায় চোখে পড়ার মতো বিষয় হল মফঃস্বলের অনুকরণে স্থানে-স্থানে ঢালাই রাস্তা। জমি-হাঙ্গরদের (পড়ুন প্রোমোটার) কল্যাণে ভাঙাচোরা মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে বেশ কিছু ফ্ল্যাটবাড়ি। তাই প্রকাশ্য দিবালোকেও কোথাও কোথাও সূর্যদেবের অনধিকার প্রবেশ নিষেধ। বাড়িগত বৈপরীত্য মনে করিয়ে দিল লক্ষ্মীছাড়া ব্যান্ডের গানের দু’কলি। “ভাঙাচোরা সব পুরনো বাড়ি/ তারই পাশে ফ্ল্যাট সব সারি সারি/ ভালো-মন্দ চলছে আড়াআড়ি।
”
এতো গেল এই এলাকার বসতি সম্পর্কিত চুলচেরা বিচার। এবার আসা যাক এখানকার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের কথায়। একটি পরিত্যাক্ত ট্যাঙ্ক যেন সভ্যতার গজদন্ত মিনার হয়ে দণ্ডায়মান। স্থানে স্থানে জল জমে তৈরি হয়েছে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জলাশয়। তাই বলে দু-একটি বড়ো জলাশয় যে নেই এটা বললে অবশ্য সত্যের অপলাপ করা হবে। সেই জলাশয় উপদ্রুত অঞ্চল মুখরিত শূয়োরের কলতানে। গুলি খেলা ও ক্রিকেট হল এই রেলসমুদ্র উপকূলবর্তী যুবসমাজের জাতীয় ক্রীড়া। যদিও ক্রিকেট খেলতে গিয়ে অতি সম্প্রতি রেল দুর্ঘটনায় জীবনের ক্রিজ থেকে তিনটে তরতাজা প্রাণকে বিদায় নিতে হয়েছে।
এই জায়গাটিতে যদিও ট্রেনের যাতায়াত খুব একটা বেশি নয়। মূলতঃ ট্রেন সাফাই করার জন্য এই অঞ্চলটিকে ব্যাবহার করা হয়ে থাকে। স্থানীয় কিছু মানুষজনের সাথে কথা প্রসঙ্গে জানা গেল এখানকার বেশ কিছু মানুষ রেলের কর্পোরেশনে কাজ করেন ও কিছু মানুষ বিভিন্ন প্রকার ব্যাবসার সাথে যুক্ত। তাদের মধ্যে কারো কারো আদি বাসস্থান বিহার। একটা প্রশ্ন মনে উঁকি দিচ্ছিল অনেকক্ষণ ধরেই। ট্রেনের অবিরাম আসা-যাওয়ার প্রতিনিয়ত শব্দে তারা কি রাত্রে ঠিক মতো ঘুমোতে পারেন? নাকি তাদের স্বপ্নেও সাম্রাজ্য বিস্তার করে ট্রেনের হুইসেল? এক যুবককে প্রশ্নটা করেই ফেললাম আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই সটান উত্তর পেয়ে গেলাম, “ না, সেসব কিছুই হয়না, সব অভ্যেস হয়ে গিয়েছে।”
এভাবেই কখনো সমান্তরাল বা কখনো সর্পিল রেল লাইনের এই জলহীন সাগর জায়গা করে নিয়েছে এখানকার মানুষের জীবনের অন্দরমহলে। সেলুলয়েডেও স্থান পেয়েছে এই অঞ্চল। লাইনের পাশের রেলিংগুলিতে জামা কাপড় শুকোতে দেওয়া হয়তো কোনও প্রতীকী তাৎপর্য বহন করে। তাই লোকাল অথবা দূরপাল্লার ট্রেনগুলি যখন সিগনালের নির্দেশে থমকে দাঁড়ায় এই জনবসতির সামনে তখন যেন কোনও নিউজ চ্যানেলের এক্সক্লুসিভ ফুটেজের মতোই আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে এই রেলসমুদ্র সৈকতের সাদামাটা দিনযাপন।
চিত্র ঋণ – গৌর মালাকার
Discussion about this post