জীবনের চলার পথে আমাদের প্রায় সবারই কোন না কোন সময় মনে হয়েছে, একবার যদি পারতাম তাহলে জীবনের ভুল ত্রুটি গুলি সারিয়ে নিতাম। বিধিলিপি সংশোধন করা আকাশ-কুসুম মনে হলেও জীবন সূত্র আবার করে লেখার বিষয়টি আর অসাধ্য সাধন নয়। হ্যাঁ, ঠিক শুনেছেন; এটা কোন গালগল্প নয়। ‘CRISPR’ সহ একাধিক অত্যাধুনিক প্রযুক্তির দৌলতে জীবন নামক পাণ্ডুলিপির সমস্ত ত্রুটি মেরামত করার কেরামতি এখন নাগালে। ‘জেনোমিক এডিটিং’ বা বংশানু সমগ্রের সম্পাদনা নিছক কল্প বিজ্ঞানের চিত্রনাট্য নয় বরং জলজ্যান্ত সত্য। জীবনের নীল নকশা ডিএনএ’কে পুনরায় ইচ্ছামত লিখে ফেলার ঐশ্বরিক ক্ষমতা খুলে দিয়েছে মানুষের জন্য বিপুল সম্ভাবনার সিংহদ্বার!
নুন আনতে পান্তা ফুরোনোর ছাপোষা জীবনে ডিএনএ’র টাইপো সারানোর ‘গায়ে মাখে না মাথায় দেয়’- জাতীয় প্রশ্ন মনে ভেসে ওঠে অবশ্যই। তবে এই প্রযুক্তির সুফল বুঝলে চোখের কোণে আশার আলো ঝিলিক মারবেই। প্রযুক্তির দক্ষিণায় জিনগত ত্রুটির ফলে অজস্র রোগ সমূলে উৎপাটন করা যাবে নিমেষেই! বংশানুক্রমিক ভাবে আমদানি করা রোগ যেমন- ডায়াবেটিস, ডাউন সিনড্রোম, বাত, হিমোফিলিয়া এমনকি ক্যান্সারও পৃথিবীর বুক থেকে ডাইনোসরের মতো বিলুপ্ত হয়ে যাবে! বংশানুসমগ্রের সংশোধনী প্রযুক্তির দৌলতে আপনি নির্ভয়ে এগিয়ে যেতে পারেন সেই মোহনায় যেখানে জিনগত ত্রুটি সারিয়ে তৈরি করা যেতে পারে ‘ডিজাইনার শিশু’, যে হবে রূপে-গুণে-দক্ষতায় সর্বশ্রেষ্ঠ!
এক নতুন বিশ্বের দিকে আমরা এগিয়ে গিয়েছি বিরাট লাফে। আমাদের আগামী প্রজন্ম হবে আমাদেরই খেয়াল খুশি মত। একটা সন্তানের মধ্যে স্টিফেন হকিংয়ের মেধা, গ্রেট খালির মত শক্তি ও উসেইন বোল্টের মত গতি পাওয়া অসম্ভব কিছুই না। কিন্তু সবার আয়ত্তের মধ্যে থাকবে না এই ইচ্ছা পূরণের ‘ম্যাজিক জিন’, তা একপ্রকার মেনেই নিয়েছেন চিকিৎসক ও বিজ্ঞানীদের মহল। জিন মেরামতির সুফল পেতে গেলে খরচ করতে হবে বিপুল অর্থ। সাধারণের নাগালের বাইরে তো বটেই জিনের টাইপো সারিয়ে সুপার হিউম্যান তৈরি করা করায়ত্ত করবে শুধু মাত্র পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ধন কুবেররা।
কল্পনা থেকে বাস্তবের চৌকাঠ পেরোতেই জিন সম্পাদনা সমাজ বিজ্ঞানীদের কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ ফেলেছে। জেগে উঠেছে সমাজ বিন্যাসকে কেন্দ্র করে বৈষম্যের মহাকায় এক প্রশ্ন চিহ্ন। বিশ্বের ভবিষ্যৎ পাল্টে দেওয়ার মতো বৈপ্লবিক প্রযুক্তির লাভ ওঠাতে পারবেন পৃথিবীর হাতে গোনা ধনী মানুষজন। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, শিল্প-দক্ষতায় যারা হয়ে উঠবে ‘অতি মানব’। এই ত্রুটি-বিচ্যুতিহীন ‘অতি মানবদের’ ঘিরে গড়ে উঠবে সমাজে অদম্য, অপ্রতিরোধ্য ও অজেয় এক পৃথক শ্রেণী। সম্পদের অসম বন্টনের দরুন অপুষ্টি ও দারিদ্র যখন বিশেষ করে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতে চরমে, তখন ‘জেনোমিক এডিটিং’র মতো প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে তৈরী করা ‘সুপার-মানব’ গজিয়ে তুলবে অসাম্যর অনাকাঙ্খিত অবস্থান। জিন সম্পাদনার বিস্ময়কর যুগে পদার্পণ তাই উচ্ছ্বাসের সঙ্গে পৃথিবীকে দাঁড় করিয়েছে নীতি-দর্পণের সম্মুখে।
Discussion about this post