জীবনযুদ্ধে হার-জিত তো রয়েছেই, কিন্তু বহু মানুষ আছেন যাদের কাছে লড়াইটাই বড়। খোঁজ নিলে দেখা যাবে পৃথিবীতে যত মানুষ সফল হয়েছেন তাদের জীবনে কোনও না কোনও সময় কোনও না কোনও বড় বাধা পেরিয়ে আসতে হয়েছে। বারবার আছাড় খেয়েই তো মানুষ হাঁটতে শেখে। মানুষকে লড়াই করেই সমাজে টিকে থাকতে হয়। ঠিক তেমনভাবেই এই সমাজে লড়াই করে টিকে রয়েছে বারুইপুরের তন্দ্রা মাখাল। অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার জন্য তাকে জীবনে এত বড়ো মাশুল দিতে হবে সে কোনোদিনই ভাবতে পারেনি। তন্দ্রা বুঝিয়ে দিয়েছেন, অতীতে ফিরে গিয়ে কখনও কিছু পরিবর্তন করা সম্ভব নয়, কিন্তু অদম্য সাহস নিয়ে জীবনটা চাইলেই নতুন করে সাজিয়ে তোলা যায়।
তন্দ্রার পৈত্রিক বাড়ি ডায়মন্ডহারবার লাইনের কল্যাণপুরে। সেখানে বহুদিন ধরে জমি-জমা নিয়ে প্রোমোটারের সঙ্গে তাদের সমস্যা লেগেই ছিল। একদিন প্রোমোটারের সঙ্গে প্রচন্ড ঝামেলা হওয়ায় প্রতিবাদ করেন তন্দ্রা। আর তখনই ঠিক ওদের টার্গেট হয়ে যায় সে। তন্দ্রা কাজ করতেন একটি পার্লারে। কাজ থেকে ফেরার সময় ট্রেনেই তার মুখে অ্যাসিড ছোড়া হয়।
অ্যাসিড হামলার কারণে পুড়ে যায় দেহের অনেকটা অংশ। একটি চোখও হারাতে হয় তাকে। অবসাদগ্রস্থ তন্দ্রা নিজেকে ঘরবন্দি করে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। দীর্ঘ পাঁচ বছর বাড়ি থেকে বেরোননি তিনি। কিন্তু “শেষ হইলেও যেন শেষ হইল না।” ২০২২ সালে বারুইপুর মহিলা থানার উদ্যোগে সম্বর্ধনা দেওয়া হয় অ্যাসিড আক্রান্তদের। তখনই তন্দ্রাকে বাড়ি থেকে বের করে আনে এক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। এরপর ‘দেওয়া-নেওয়া’ নামে পুরনো-জামা কাপড় সংগ্রহ করে দরিদ্রদের মধ্যে বিলিয়ে দেওয়ার প্রকল্পে যুক্ত হন তিনি। এইভাবে আস্তে আস্তে তিনি নিজেকে মানসিক অবসাদ থেকে বের করে নিয়ে আসেন।
এই প্রকল্পে বারুইপুর স্টেশন চত্বরে বসবাসকারী কিছু শিশু তন্দ্রার কাছ থেকে জামা কাপড় নিতে আসত। এই শিশুদের মূল স্রোতে ফেরানোর পরিকল্পনা করেন বেবিল্যান্ড ফাউন্ডেশনের কর্ণধার বিমান দত্ত। সঙ্গে পাশে থাকেন তন্দ্রা। এরপর তাদেরই উদ্যোগে ১০-১২ বছর বয়সী শিশুদের পড়াতে শুরু করেন তন্দ্রা। উনি জানান, “এক সময়ে ভেবেছিলাম জীবনটা শেষ। এখানে এসে নতুন জীবন পেয়েছি। এখন আমার মতোই অন্ধকারে হারিয়ে যেতে বসা এই ছেলে-মেয়েদের একটা অন্য রকম জীবন দেওয়ার চেষ্টা করছি।” জীবনের অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়েছেন তন্দ্রা। মনোবল ও আত্মবিশ্বাসের জোরেই পৌঁছেছেন সাফল্যের চরম শিখরে।
চিত্র ঋণ – বঙ্গদর্শন ডট কম
Discussion about this post