উত্তরবঙ্গ মানেই যে নদীর নাম সবার আগে মনে আসে সেটা হল তিস্তা। উত্তরের বুক চিরে বয়ে গিয়েছে এই নদী। এটি রাজবংশীদের কাছে শুধু নদী নয় একজন দেবী। তাই এই নদীর সাথে এখানকার মানুষের আত্মীয়তার বন্ধন রয়েছে। তিস্তাকে তারা ‘তিস্তা বুড়ি’ নামে সম্মানিত করেন এবং প্রতি বছর গ্রীষ্মকালে বা বর্ষার মুখে ‘তিস্তা বুড়ির পুজো’ করে থাকেন। এই পুজো রাজবংশী সংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ, যা তাদের ঐতিহ্য, রীতিনীতি ও বিশ্বাসের প্রতিফলন ঘটায়।
কখনও বর্ষায় তিস্তার জলোচ্ছ্বাসে বাসিন্দাদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। আবার কখনও গ্রীষ্মের মরসুমে জলের জন্য হাহাকার, ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হয় চাষের জমি। এই সব কিছু থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্যই করা হয় এই পুজো। রাজবংশীদের মতে, এই পুজো শুধু নদীকে তুষ্ট করে তাই নয়, এই পুজোয় অংশগ্রহণ করলে পারিবারিক বিবাদও মেটে।
স্থানীয় মানুষদের কাছে এটি মূলত মিলন উৎসব। এই পুজোকে কেন্দ্র করে করোতোয়া নদীর ঘাটে বিস্তীর্ণ এলাকার মানুষ ভিড় করেন। কলা গাছ দিয়ে সুসজ্জিত ছোট ভেলা তৈরি করে তিস্তা বুড়ির পুজো করা হয়। ভক্তরা নিয়ম নিষ্ঠার সঙ্গে পুজোয় অংশগ্রহণ করেন এবং পুজো শেষে নদীতে ওই ভেলা ভাসিয়ে দেওয়া হয়। এই পুজোকে ঘিরে মহিলারা সিঁদুর খেলায়ও মেতে ওঠেন। পুজোর শেষে সকলকে প্রসাদ বিলি করা হয়। স্থানীয় পুরোহিতের থেকে জানা যায়, এই পুজোর সমস্ত সামগ্রী তথা প্রসাদ মানুষের কাছ থেকে ভিক্ষা করেই যোগাড় করা হয়। তারপরে এই পুজোর আয়োজন করা হয়। এটাই নাকি পুজোর রীতি।
পুজো দেওয়ার পর নিরামিষ খান স্থানীয় মানুষজন, সঙ্গে নাচ-গানেরও আয়োজন করা হয়। এই পুজোকে কেন্দ্র করে জলপাইগুড়ির রাজবাড়ীতে হয় মেচেনী মেলা। এখানে একটি লোকগানের প্রচলন রয়েছে সেটি হল মেচেনী গান। এই লোকগানের ক্ষেত্রে মূলত ধামসা, বাঁশিই বেশি ব্যবহৃত হয়। কিন্তু আধুনিকতার জন্য স্থানীয় মানুষজন ঐতিহ্যটি হারাতে বসেছিল। তবে বর্তমানে এই ঐতিহ্য ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছেন নর্থ-ইস্টার্ন ফাউন্ডেশন ফর সোশ্যাল সায়েন্সেস রিসার্চের সদস্যরা। জলপাইগুড়ি ছাড়াও ধূপগুড়ি, মেখলিগঞ্জ, রাজগঞ্জ, মালবাজার ইত্যাদি ব্লক থেকে ৪৬ টি দল এখানে অংশগ্রহণ করে।
প্রচ্ছদ চিত্র ঋণ – বাপন দাস
Discussion about this post