ছোটবেলায় পড়া ভুগোল বইটার কয়েকটা পাতার কথা মনে পড়ে? সেই যে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৪২০ মিটার নীচে অবস্থিত মৃত সাগর; পৃথিবীর নিম্নতম স্থলভূমি? যেখানে মানুষ দিব্যি ভাসতে পারে জলে, সেই কাহনই বলব আজ। ইসরায়েলে আমার যে বাড়ি সেখান থেকে ডেডসির দূরত্ব মাত্র দেড়শো কিলোমিটার। বাসে করে যেতে সময় লাগে হাতে গুনে ঘন্টা খানেক। এক ভূমধ্যসাগরীয় শীতের বৃষ্টিভেজা সকালে পাড়ি জমিয়েছিলাম সেই মৃত্যু উপত্যকাতেই।
বলাই বাহুল্য, এদেশে এখন ঘোরতর শীতকাল। সঙ্গে পশ্চিমাবায়ুর প্রভাবে যখন তখন বৃষ্টি। এই সময়টাই সেরা সময় ডেডসি যাওয়ার। নাহলে সমুদ্রপৃষ্ঠের অতখানি নীচে গরম এতটাই বেড়ে যায় যে পৌঁছে গেলেও টেকা দুষ্কর হয়ে পড়ে। বাসে চড়ে বসার মিনিট পঁয়তাল্লিশের মধ্যেই চারিদিকের হলুদ সর্ষেক্ষেত আর ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বাড়িঘরগুলো কেমন যেন ভ্যানিশ হয়ে যেতে লাগল অদৃশ্য কোনও জাদুকরের ম্যাজিকে। বদলে জানলার দুদিকের দৃশ্যপটে ধরা দিল মাসাদা জাতীয় উদ্যানের মঙ্গল গ্রহের মতন লালচে পাহাড় আর মরুভূমি। রাস্তার এখানে ওখানে সাইনবোর্ডে আঁটা হিব্রুতে লেখা সতর্কবার্তা ; যার আক্ষরিক বাংলা অনুবাদ ‘জংলী উট হইতে সাবধান’। আজীবন বাংলার সবুজে বেড়ে ওঠা বঙ্গতনয়ার কাছে এ বড় অদ্ভুত ছবিই বটে। ডেডসিতে পর্যটকদের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় হল কালিয়া বিচ। ভেবেছিলাম সেখানেই যাব। কিন্তু বাসের জানলা দিয়ে দিগন্ত জোড়া নীলচে সাদার ছোপ দেখে আর যেন বসে থাকা গেল না কিছুতেই। ঝুপ করে নেমে পড়লাম ওই মরুভূমির মধ্যেরই অচেনা অজানা নামহীন এক তটে।
এক সাগর যেখানে মানুষ জলে ভাসে, ছোটো থেকেই এই কথাটা অবাক করত বড্ড। আজ সেই ডেডসির তীরেই দাঁড়িয়ে আছি বিশ্বাস করতেও যেন সময় লেগে যায় অনেকটা। যুদ্ধবিধ্বস্ত বিভুঁইতে এ যেন এক অদ্ভুত স্বপ্নপূরণ। নামে সমুদ্র থাকলেও ডেডসি কিন্তু আদতে একখানা লবণ হ্রদ। সমুদ্র থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে জল শুকোতে শুকোতে লবণের মাত্রা গিয়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৩০ শতাংশে। যা কিনা সমুদ্রের জলের চেয়ে প্রায় ৯ গুণ বেশি নোনা। এই জল লবনের কারণে এতটাই ভারী যে মানুষ চাইলেও ডুবতে পারে না এত জলে। আপেক্ষিক ঘনত্বের কারণে ভেসে থাকে জলের উপর। একই কারণে কোনও জীবের অস্তিত্ব নেই এই হ্রদে। মাছ তো দূর, এতটুকু শ্যাওলার চিহ্নও নেই কোথাও। যতদুর চোখ যায় তটরেখা ধরে শুরুই সাদা লবনের স্তর।
নামে মৃত সাগর হলেও রূপচর্চার ক্ষেত্রে কিন্তু কার্যতই যেন মৃতসঞ্জীবনী বুটি এই হ্রদ। ডেডসির কাদা, জল, নুন সবই প্রসাধন হিসেবে অত্যন্ত চমৎকার। এর জলে মিশে থাকা বিভিন্ন খনিজ মৌলের কারণে সোরিয়াসিস,শ্বেতির মতন ত্বকের রোগ থেকে শুরু করে বাত অবধি সেরে যায় ডেডসিতে স্নান করার পর। সঙ্গে ত্বকে আসে অদ্ভুত এক উজ্জ্বলতা। প্রাচীনযুগেও ডেডসি এতটাই বিখ্যাত ছিল যে মিশর সম্রাজ্ঞী ক্লিওপেট্রা স্বয়ং তাঁর প্রসাধনে ব্যবহার করতেন এখানকার নুন,জল, কাদা। তাঁর ভুবনজয়ী রূপের পিছনেও হাত কিন্তু এই হ্রদেরই। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, সমুদ্র থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার কারণে কিন্তু প্রতিমুহূর্তেই বেড়ে চলেছে মৃত সাগরের মৃত্যুর ঝুঁকি। ইসরায়েল সরকার এই হ্রদকে বাঁচাতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিলেও তা কতখানি সুদূরপ্রসারী হবে সে নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। আর ঠিক কতদিন আয়ু এই জাদু হ্রদের, সে প্রশ্নেরও জবাব মেলে না ঠিকমতো। তাই তার আগের কোনও এক শীতে অবশ্য গন্তব্যের তালিকাতেই থাক নাহয় এই মায়াবী সাগর।
Discussion about this post