কিংবদন্তি ইংরেজ কবি শেলী লিখেছিলেন- সূর্যকিরণ ছুঁয়ে যায় ভূমির ঠোঁট, চন্দ্রপ্রভা চুম্বন করে সাগর; এ সকল চুম্বনেরই বা মূল্য কী যদি তোমার ঠোঁট ছুঁলো না আমার ঠোঁট! চলতি বছরের ভ্যালেন্টাইন সপ্তাহের ‘কিস ডে’ মহা সমারোহে পালিত হচ্ছে আজ। আজ প্রেমের বাঁধনে ধরা দেওয়া যুগলদের আশ্বাসের-বিশ্বাসের ঠোঁটে বাঁধা পড়ার দিন। উষ্ণ ভেজা ঠোঁটের স্পর্শে ভালোবাসার বার্তা পৌঁছে যাবে মনের ডাকবাক্সে। বিজ্ঞানীদের মতে ঠোঁট আমাদের শরীরের সব চাইতে স্পর্শকাতর অঙ্গ যার দশ লক্ষেরও বেশি স্নায়ুর সংযোগ মস্তিষ্কের সঙ্গে। চুম্বন তাই দিয়ে দেয় সঙ্গীর মনের হদিস। নিমেষে ছড়িয়ে দেয় ভালোবাসার রঙ। মন দেওয়া-নেওয়ার প্রতীক হিসেবে চুম্বনের অভ্যাস মানুষের প্রাচীন কাল থেকেই। যীশু জন্মানোর ৮০০ বছর আগে ইরানের ভূমি খনন করে চুম্বনরত ‘হাসানলু কঙ্কাল দম্পতি’ তার প্রমাণ।
চুম্বন ভালোবাসার প্রতীক রূপে পূজিত হয়েছে সাহিত্যে-সঙ্গীতে-শিল্পে। বিবর্তিত পৃথিবীর সমাজ জীবনে চুম্বন বস্তাপচা প্রথার বিরুদ্ধে আবার সেজে উঠেছে প্রতিবাদীর রূপেও। পৃথিবীর তরুণ নবারুণের আশায় বন্দি হয়েছে ঠোঁটে। শাসকের নেমে আসা তরবারির সামনেও অকুতোভয় ঠোঁটের মিছিল ভেঙেছে ব্যারিকেড, পেরিয়েছে কাঁটাতার। এমনই এক চুম্বনের ছবি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে বিশ্ববিখ্যাত হয়ে যায়। ছবিটা তোলেন বেটম্যান নামক ব্রিটিশ চিত্রগ্রাহক। সাদা কালো ছবিতে দেখা যায় এক ব্রিটিশ যুগল গ্যাস মাস্ক পরে এক অপরকে চুম্বন করছেন। বলাই বাহুল্য, সাম্রাজ্যবাদের নেশায় বুঁদ পৃথিবীর অগ্রণী শক্তিদের স্বার্থ বিজড়িত ভয়ঙ্কর যুদ্ধ গোটা দুনিয়ার স্বাভাবিকতাকে নষ্ট করে দেয়। হিটলারের আদেশে ব্রিটিশ আকাশে ঘুরপাক খাওয়া যুদ্ধবিমান দেখে ব্রিটেনে চরম সতর্কতা জারি করা হয় বিষাক্ত গ্যাসের আশঙ্কায়। নির্দেশ দেওয়া হয় নির্বাচিত অঞ্চলের অধিবাসীদের মাস্ক পরে থাকার। প্রবল আতঙ্কে ইংরেজ জনসাধারণ প্রমাদ গুনতে শুরু করে।
সালটা ছিল ১৯৪০, তারিখটা পয়লা নভেম্বর। ক্রিসমাসের আনন্দ আবার মাটি হওয়ার প্রতিবাদে এই প্রেমিক যুগল গ্যাস মাস্ক পরে ক্যামেরার সামনে ধরা দেন চুম্বনরত কায়দায়। ধরা পড়ে ইংরেজ সহ যুদ্ধে বিপর্যস্ত কোটি কোটি মানুষের অসহায়তা। রুটি-রুজির সঙ্গে ভেস্তে গিয়েছিল মানুষের সাধারণ ইচ্ছে-আকাঙ্খা-স্বপ্ন-অভিলাষাগুলি। বিশ্বযুদ্ধে লাভ মুষ্টিমেয় স্বার্থ-অন্ধ শাসক ও পুঁজিপতিদের হলেও অপূরণীয় ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছিল পৃথিবীর সাধারণ মানুষ, পশু-পাখি ও প্রকৃতি। বেটম্যানের ভুবন বিখ্যাত আলোকচিত্র তাই যুদ্ধবিদ্বেষী স্লোগানের পোস্টার ফটোগ্রাফ হিসেবে বন্দিত হয়েছিল সারা দুনিয়ায়। যুদ্ধের নিন্দায় সরব হয়েছিল পৃথিবী। চুম্বন তাই শুধু দুই মনের বার্তাবাহক হয়ে সীমিত থাকেনি। যুদ্ধের কারিগরদের বিরুদ্ধে ছুঁড়ে দিয়েছিল ঠোঁটের অভ্রান্ত মিসাইল।
Discussion about this post