বর্তমানে ‘জর্জ ফ্লয়েড’ নামটা ভীষণই আলোচিত একটি নাম। অন্যদিকে এই নামের সাথে জড়িয়ে রয়েছে আরও একটি নাম, ‘আংকেল টমস কেবিন’। যে উপন্যাসকে বলা হয় কৃষ্ণাঙ্গদের লড়াইয়ের প্রথম সোপান। আমেরিকার ইতিহাসে কৃষ্ণাঙ্গদের ওপর শেতাঙ্গদের অত্যাচার ও দাস প্রথার বিরুদ্ধে প্রথম গর্জে উঠেছিলেন লেখিকা ‘হ্যারিয়েট বিচার স্টো’ তার আঙ্কল টমস কেবিনের মাধ্যমে। মাত্র এক বছরেই বইযটির প্রায় তিন লক্ষ কপি বিক্রি হয়ে যায়। এই বইয়ের পরতে পরতে রয়েছে দাসদের ওপর অত্যাচারের কাহিনী। ‘আংকেল টমস কেবিন’ প্রকাশের ঠিক পরের বছরই তিনি ‘আ কি টু আংকেল টমস কেবিন’ নামক আরেকটি বই প্রকাশ করেন। এই বইটিতে তিনি তুলে ধরেন দাসদের সত্যিকারের কষ্টের জীবনের কথা, দাসত্ব থেকে পালিয়ে যাওয়ার কথা।
আঠারোর শতকে দক্ষিণ আমেরিকার রাজ্যগুলো ছিল পুরো মাত্রায় দাস-নির্ভর। অন্যদিকে উত্তর আমেরিকা ছিল দাস প্রথার বিরোধী। যা উত্তর-দক্ষিণের রাজনৈতিক যুদ্ধ বাধার অন্যতম কারণ ছিল। ফলতঃ এরকম একটি বই সে সময় দক্ষিণ আমেরিকার মানসিকতাকে যে নাড়িয়ে দিয়েছিল তা বলাই বাহুল্য। বইটির জনপ্রিয়তা এতটাই তুঙ্গে উঠেছিল যে মানুষ সচেতন হয়ে উঠতে শুরু করে দাসদের ব্যাপারে।
আমেরিকা স্বাধীনতা পাওয়ার পর থেকেই দাসপ্রথার শুরু। এই কৃষ্ণাঙ্গ দাসরা মূলতঃ ছিলো আফ্রিকা বংশভূত। ১৮৫৩ সালে স্কট নামক এক দাস আমেরিকার সুপ্রিম কোর্টে মুক্তির জন্য মামলা করে। এই মামলার রায় বেরোয় ৪ বছর পর ১৮৫৭ সালে। যা দাসদের মুক্তির পালে হাওয়া লাগায়। সুপ্রিম কোর্টের রায়ে বলা হয়,’আফ্রিকান বংশোদ্ভূত কেউ আমেরিকার নাগরিক হিসেবে গণ্য হবে না, সে দাস হোক আর মুক্ত! আর যেহেতু তারা আমেরিকার নাগরিক নয়, তাই আইনত আমেরিকায় তাদের কোনো অধিকারও নেই। এছাড়াও যেহেতু দাসরা আমেরিকার নাগরিক না এবং তাদের কোনো নাগরিক অধিকার নেই, সেহেতু কেন্দ্রীয় সরকার রাজ্য কিংবা দাস মালিকদের ব্যাপারে নাক গলাতে পারবে না!’
এই রায়ের ফলে দাসদের পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হলেও, আমেরিকার ভেতরের পরিস্থিতি প্রকট হয়ে ওঠে। ১৮৫০-র পর দাস প্রথা নিয়ে উত্তর ও দক্ষিণের রাজ্যগুলোর মধ্যে বিভেদ বাড়তে থাকে। এদিকে ১৮৬০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন, অন্তর্দ্বন্দ্ব, রাজনৈতিক তরজা সৃষ্টি করে বিভেদ। শুরু হয় গৃহযুদ্ধের। এমন পরিস্থিতিতে ওই বছরই ডিসেম্বরে দক্ষিণ ক্যারোলিনা নিজেকে বিচ্ছিন্ন স্বাধীন দেশ হিসেবে ঘোষণা করে। আবার দক্ষিণ ক্যারোলিনার বিচ্ছিন্ন হবার কিছুদিনের মাধ্যেই একে একে মিসিসিপি, ফ্লোরিডা, টেক্সাস, আলাবামা, জর্জিয়া ও লুইজিয়ানাও নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে নেয় কেন্দ্র থেকে। অন্যদিকে ১৮৬১ সালের ৬ মার্চ লিংকন প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব গ্রহণ করেন গৃহযুদ্ধের সম্ভাবনা নিয়ে। তিনি ঘোষণা করেন দাস প্রথা বন্ধ করার কোন পরিকল্পনা তার নেই। আবার এও জানিয়ে দেন দক্ষিণের দেশগুলির নিজেদেরকে আলাদা করে নেওয়ার পরিকল্পনা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া হবে না। ১২ এপ্রিল কনফেডারেট সেনারা দক্ষিণ ক্যারোলিনার সামটার দুর্গে আক্রমণ করলে দক্ষিণ ক্যারোলিনা বিনা যুদ্ধে আত্মসমর্পণ করে। বিনা যুদ্ধে জয়লাভ করে কনফেডারেশন। এমতো পরিস্থিতিতে আরকানসাস, ভার্জিনিয়া, টেনেসি ও উত্তর ক্যারোলিনা বিদ্রোহ ঘোষণা করে কনফেডারেশনে যোগ দেয়।
কাজেই সব শেষে একটা কথাই বলা যায়, আঠেরোর শতকে আমেরিকার অন্তর্দ্বন্দ্বের পিছনে রয়েছে একাধিক টানাপোড়েনের গল্প। দাসদের লড়াই, স্বাধীনতার যুদ্ধ, অবস্থার উন্নতি এ সবের সাথে প্রথম সেতুবন্ধনটা কিন্তু করেছিল ‘আংকেল টমস কেবিন’ই। যা আজও আমেরিকার ইতিহাসে বহুল চর্চিত একটি বিষয়।
Discussion about this post