আরামবাগ মোড় থেকে কমলাপুর রেলস্টেশনের দিকে চলে গিয়েছে একটি রাস্তা। ঠিক সে রাস্তার মুখে হাতের বাঁ দিকে ফুটপাতে একটু তাকালে চোখ আটকে যেতেই পারে। প্রায় দুই ফিট উঁচু ইটের গাঁথুনির একটি কবর আড়াআড়িভাবে ফুটপাতের বেশ খানিকটা জুড়ে দৃশ্যমান। এ পথে যেতে বহুবার দেখেছি কবরটি। রং উঠে যাওয়া সমাধি লিপিতে লেখা, “শহীদ মুক্তিযোদ্ধা মোঃ আজিজুল হক, জন্ম -১লা মে ১৯৫০, মৃত্যু – ৩১শে ডিসেম্বর ১৯৭১।” যতবারই এ কবরের সামনে দাঁড়িয়েছি মৃত্যুর তারিখটি নিয়ে কৌতূহল হয়েছে প্রতিবার। কিন্তু সে অর্থে খোঁজ নেয়া হয়নি কখনও। এবার বিজয় দিবসের দিন সকালে বেরিয়ে ঠিক করলাম খোঁজ নিয়ে দেখা যাক, কেন বিজয় অর্জনের ১৪ দিন পর তাঁকে শহীদ হতে হল!
কবরের পাশে ছোট একটি পানের দোকান দেখতে পেলাম, তখনও তা বন্ধ। পাশের আরেকটি দোকানের কর্মচারীর কাছে জানতে চাইলাম কবর সম্পর্কে, কিন্তু তিনি কিছুই জানাতে পারলেন না। এ বিষয়ে কে জানাতে পারবেন? এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি পান দোকানির কথা বললেন। সমস্যা হল দোকানী তখনও আসেননি। দোকানি যখন এলেন, ঘড়িতে তখন বেলা ১১টা, কিন্তু এবারও আশাহত হতে হল। দোকানি জানালেন তিনি এ এলাকায় এসেছেন বেশি দিন হয়নি। তবে এজিবি কলোনির আল হেলাল জোনের পূর্ব পাশের গেটে শহীদ এই মুক্তিযোদ্ধার ভাই একটি মুদি দোকান চালান বলে জানালেন তিনি। তবে নাম বলতে পারলেন না। ছুটলাম সে দিকে। বিধি বাম, এ দোকানটিও বন্ধ! তবে জানা গেল দোকানির নাম জাহাঙ্গীর। কিন্তু তিনি কোথায় থাকেন, কখন আসবেন কেউ বলতে পারল না।
অনেকটা নিরুপায় হয়ে কলোনির এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে চষে বেড়ালাম, নানা বয়সের মানুষের সাথে আলাপ করলাম। সকলেরই বক্তব্য প্রায় এক, “তাঁরা শুনেছেন এটি একজন শহীদ মুক্তি যোদ্ধার কবর।” এর বেশি আর বিশদভাবে কিছু বলতে পারলেন না। অবশ্য এর কারণও আছে। ৫২ বছরের পুরনো ঘটনা, কলোনিতে কেউই স্থায়ী নন। চাকুরী থেকে অবসরের পর সকলকেই নির্দিষ্ট একটি সময় কলোনি ছাড়তে হয়। এভাবে কয়েকটি প্রজন্ম কলোনি ছেড়েছে। আশাবাদী হওয়ার একটি সুযোগ ছিল, সাধারণত কলোনি স্থায়ীভাবে ছাড়লেও একসময়কার বাসিন্দাদের যাতায়াত চলতে থাকে নিয়মিত। হঠাৎ একটি সম্ভাবনা উঁকি দিল যখন আল হেলাল জোনে মোঃ সুজন নামের এক তরুণ সব শুনে এগিয়ে এলেন। মুদি দোকানি জাহাঙ্গীর আলমের বাসা তিনি চেনেন। যখন সেখানে পৌঁছলাম, তখন চারপাশে আঁধার নেমেছে। পরিচিত গলার স্বর শুনে জাহাঙ্গীর বেরিয়ে এলেন। কবরটি তাঁর ভাই মোঃ আজিজুল হকের বলে নিশ্চিত করলেন।
জাহাঙ্গীর জানালেন, “আমাদের বাড়ী লক্ষ্মীপুর জেলার, রামগঞ্জ থানার সোনাপুর গ্রামে। বাবা পিডব্লিউডি’তে চাকরি করতেন, সেই হিসেবে আমরা কলোনিতে থাকতাম। বি-২২ ভবনের জি-১ ফ্ল্যাটে আমরা পরিবারসহ থাকতাম। সাত ভাইয়ের মধ্যে আজিজুল ভাই চতুর্থ, আর আমি পঞ্চম। আজিজুল ভাই মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন, তিনি যখন মারা গেলেন আমি তখন গ্রামে অবস্থান করছিলাম। পরে বাবা-মা’র কাছে শুনেছি, রাতে কলোনির ছেলেরা মিলে কলোনি পাহারা দিতে গিয়ে দুষ্কৃতীদের গুলিতে তিনি মারা যান’।
জাহাঙ্গীর আরেকটি তথ্য দিলেন। বললেন, “আজিজুল ভাইয়ের বন্ধু জাহান ভাই এখনও কলোনিতে আসেন প্রতি সন্ধ্যায়, আপনি তাঁর সাথে এ বিষয়ে কথা বলতে পারেন।” পাশ থেকে মোঃ সুজন বলে উঠলেন, “জাহান ভাই কোথায় বসেন তা আমি জানি। চলুন আমি আপনাকে নিয়ে যাচ্ছি।” নির্দিষ্ট স্থানে গিয়ে দেখা গেল জাহান তখনও আসেননি। ঘন্টা খানেক অপেক্ষার পর তাঁর সাথে সাক্ষাতের সুযোগ হল। সব কিছু শুনে মোঃ জাহান বললেন, “আমি আর আজিজুল সমবয়সী ছিলাম। আজিজুল মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিল, আমি যাইনি। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের পর কলোনির যারা যুদ্ধে গিয়েছিলেন সবাই ফিরে আসেন। আজিজুলও ফিরে আসে। আমাদের এলাকা তখন বিহারি অধ্যুষিত ছিল। যারা রাজাকার তারা তখনও এখানে সক্রিয় ছিল। কলোনির যুদ্ধ ফেরত ছেলেরা ঠিক করল, রাতে কলোনি পাহারা দেবে, কারণ তারা যে কোনো সময় কলোনিতে ঢুকে পড়তে পারে। আজিজুলের সাথে আমিও যোগ দিলাম। রাতে সবাই পালা করে পাহারা দিতাম। ৩১ ডিসেম্বর রাতে ২০ নম্বর ভবনের মাঝের সিঁড়িতে আজিজুল পাহারা দিচ্ছিল, সে সময় কাঁচাবাজারের মোড় থেকে হঠাৎ রাজাকাররা গুলি করলে আজিজুলের বুকে গুলি লাগে, ঘটনাস্থলেই তিনি শহীদ হন।”
মোঃ জাহান আরও জানালেন, পরদিন জানাজার নামাজ শেষে আল হেলাল জোন মসজিদের অজুখানার পাশে তাকে কবর দেওয়া হয়। পরবর্তীতে মসজিদের পুরনো ভবন ভেঙে একটু ভেতরে মসজিদটি পুনঃনির্মাণ করা হয়, পরে কলোনির চারপাশে পাঁচিল তৈরী হলে কবরটি তার বাইরে পড়ে যায়। বিজয়ের ৫২ বছর, অনেক দীর্ঘ সময়। চাপা পড়ে যায়, ধুলো জমে যায় অনেক কিছুতেই। শহীদ আজিজুলের কবরটি হয়তো চাপা পড়বে না। কিন্তু বিস্মৃতির অতলে চলেও যেতে পারে।
Discussion about this post